হত্যার ‘দায়’ বিএনপির, সংলাপ সময়ের দাবি

দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে সরকার ও বিরোধী জোটকে অতিদ্রুত সংলাপ বা আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনীতিকরা। তারা মনে করছেন দেশ বাচাঁতে, মানুষ বাঁচাতে এখনই সংলাপের উপযুক্ত সময়। সংলাপ অনেকটা সময়ের দাবিও বটে।

দেশের চলমান সহিংসতার অবসান এবং মানুষের জানমাল রক্ষার্থে কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ সে ব্যাপারে যাওয়া হয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাছে।

তিনি বলেন, ‘আমি বার বার বলে আসছি প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় বসুন, খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করুন। চলমান সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি কোনো দলের প্রধানমন্ত্রী নন, দেশের ষোল কোটি নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী।’

দেশের শান্তি ও মঙ্গলের জন্য আলোচনায় বসতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার কথা বলছি না। যদি শান্তির জন্য চাড়ালের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে হয়, তাই করা উচিৎ প্রধানমন্ত্রীর। সেই সঙ্গে দেশের শান্তির জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ারও উচিৎ অবরোধ প্রত্যাহার করা।’

সংলাপ হলে কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংলাপ হলে দেশের মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি অর্থবহ আলোচনা হবে কীভাবে তাদেরকে রক্ষা করা যায়। সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে দেশে একটি ভালো ভোট হতে পারে। একটি ভালো ভোটই পারে দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে।’

চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে মানুষের মুক্তির দাবিতে মতিঝিলে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ১৩ দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও তার দলের নেতাকর্মীরা।

দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ফুটপাতেই থাকছেন এবং সেখানেই খাওয়া-দাওয়া ঘুমানোসহ সব কাজ সারছেন তিনি। তবে গত শুক্রবার জুমআর নামাজে গেলে ওই ফাঁকে তার মঞ্চ, শামিয়ানা, কাঁথা-বালিশ সব নিয়ে যায় পুলিশ। নামাজ শেষে এসে দেখেন মঞ্চ নেই। তখন তিনি ফুটপাতে মাদুর বিছিয়ে অবস্থান নেন। এখন পর্যন্ত সেভাবেই আছেন মুক্তিযুদ্ধের এই কিংবদন্তি। তিনি জানিয়েছেন, যতোদিন বাংলার মানুষের শান্তি তথা অবরোধ প্রত্যাহার ও আলোচনা না হবে ততোদিন মতিঝিলের ফুটপাতেই অবস্থান করবো আমি ও আমার দল।

চলমান সঙ্কট এড়াতে সরকার ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের মধ্যে একটি সংলাপের আহ্বান করা যেতে পারে কি না প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘দেশের চলমান সহিংসতা থেকে জনগণকে বাঁচাতে জনপ্রতিরোধ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। দেশে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করছে, তাদেরকে দমন করতে জনগণ ও প্রসাশনকে এগিয়ে আসতে হবে।’

এজন্য সংলাপ বা আলোচনার প্রয়োজন আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে একটি সংলাপ হতে পারে, তবে সেটি পূর্বশর্ত দিয়ে নয়। বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এম হাফিজ উদ্দিনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, সহিংসতার জন্য তারা দায়ী। বিএনপির এ নেতার বক্তব্য প্রমাণ করে তারা কর্মসূচি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করছেন।’

তিনি বলেন, ‘মেজর হাফিজ বলেছেন- সরকার যদি নির্বাচনের জন্য সংলাপের ডাক দেয় তাহলে আমরা আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো। এ থেকে বোঝা যায় চলমান সহিংসতার জন্য তার দল বিএনপি দায়ী।’

অলিক শর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না এমন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, ‘পূর্বশর্ত দিয়ে সংলাপ হবে না। বিএনপি হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করলে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে সংলাপ করা যেতে পারে।’

পূর্বশর্ত ছাড়া কি সংলাপ হতে পারে না এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, ‘হ্যাঁ দেশের মানুষকে রক্ষা করতে ও দেশের সার্বিক অবস্থার বিষয় নিয়ে একটি সংলাপ হতে পারে। তবে সংলাপের আগে তাদের কর্মসূচি (বিএনপির) প্রত্যাহার করতে হবে। তারা যদি সত্যিকারের একটি সংলাপ চায় সে ক্ষেত্রে তারা আন্দোলন বন্ধ করে আলোচনার প্রস্তাব দিক।’

দেশের চলমান সঙ্কট সমাধানে সংসদ নির্বাচন এই মুহূর্তে জরুরি কি না এবং সেটি কবে করা উচিৎ এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ  বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মানুযায়ী একটি দেশের সকল ক্ষমতার উৎস ভোটার। ভোটারদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন করা গণতান্ত্রিক নিয়ম। কিন্তু সে নিয়মের ব্যতয় ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের উচিৎ দেশের সাধারণ ভোটারদের হাতে নির্বাচন ছেড়ে দেয়া। জনগণ ভোট দিয়ে যাকে নির্বাচিত করবে সেই ক্ষমতায় বসে দেশ পরিচালনা করবে।’

দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। যদি ওই নির্বাচন ভোটারদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে হতো তাহলে দেশের এ অবস্থা তৈরি হতো না বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

সংলাপে বিদেশি মধ্যস্থতার প্রয়োজন আছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিদেশিদের সহযোগিতা কামনা করা ঠিক নয়। কারণ, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিরা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি, যে সরকার যখন ক্ষমতায় যায় তারা তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। কিন্তু এরকম কেউই বেশিদিন টিকতে পারেনি। এক সময় না এক সময় এটির সমাধান হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ভিত ঠিক আছে, তবে তার চর্চা নেই। যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে সে সরকার তখন গায়ের জোরে নিজেদের মতো করে দেশ চালাতে চায়। প্রশাসনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করায় দুর্ভোগের শিকার হন দেশের সাধারণ মানুষ।’

তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। স্বাধীনের পর কিছুদিন গণতন্ত্র ছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা স্বৈরাতন্ত্রে পরিনত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ আর এগুতে পারবে না।’

চলমান পরিস্থিতিতে দেশ গভীর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে দেশে এরকম অবস্থার সৃষ্টি হতো না। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সঙ্কট বর্তমান সরকার তৈরি করেছে। সরকার বলেছিল ৫ জানুয়ারি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, কিন্তু পরবর্তীতে এসে সরকার বললো ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এ ধরনের চিন্তা সরকারের মোটেও ঠিক নয়।’

সঙ্কট নিরসনে কি ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলমান সঙ্কট নিরসনে একটি অর্থপূর্ণ, কার্যকরী রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এটি করতে হলে সরকারকে বিএনপিসহ সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।’

হরতাল-অবরোধে পুড়ে মারা যাওয়া নিরীহ মানুষদের দায়ভার কার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলমান আন্দোলনে অনেক নিরীহ মানুষ পুড়ে মারা যাওয়ার দায়ভার ২০ দলীয় জোট ও সরকারের। দুই পক্ষকেই এর দায়ভার নিতে হবে।’

এ দায় বিএনপি কেন নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুল হক বলেন, ‘যেহেতু এ রকম কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আর এর মধ্যেই মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই এর দায়ভার তাদের।’

বিএনপি অভিযোগ করছে সরকারি এজেন্টরাই পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হরতাল অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কাজেই এ কর্মসূচিতে যারা নিহত হবে তার দায়ভার জোটকেই নিতে হবে।’

সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে বিএনপি, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে কার্যত সরকার তার রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে অগণতান্ত্রিক পথের দিকে যেতে উস্কানি দিয়েছে। আর বিএনপি এই ফাঁদে পা দিয়েছে। তবে পেট্রোলবোমার যে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে, এটা কেবল বিএনপির রাজনীতিকেই ধ্বংস করবে না, দেশকেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। বিএনপি এ তৎপরতা বন্ধ না করলে তাদের আম ছালা দুটিই যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, সরকার যেভাবে বিএনপিকে আইএস বানাতে চাচ্ছে তাতে এই তৎপরতা কেবল বিএনপিই নয়, সরকার ও দেশের জন্যও বুমেরাং হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি বিএনপিকে সভা-সমাবেশসহ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার সুযোগ দিতো, তাহলে তারা এরকম কঠোর আন্দোলনে নামার সুযোগ পেতো না। এতো নিরীহ লোক মারা যেতো না।’

বর্তমান পরিস্থিতি তৈরির জন্য সরকারও দায়ী কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার বিরোধী জোটের নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিচ্ছে। এতে করে তারা কর্মসূচির ঘোষণা করছে। সরকার যদি বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এতো মিথ্যা মামলা জুড়ে না দিতো তাহলে তারা (বিএনপি) সহিংস আন্দোলনে যেতো না। কাজেই দায় সরকারেরও আছে।’

তিনি বলেন, ‘সঙ্কট উত্তরণে সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে বোঝাপড়া জরুরি। এ জন্য সরকারকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধের সুষ্পষ্ট প্রমাণ নেই তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা তুলে নিয়ে বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরত দেয়া উচিৎ।’

সরকার মহাজোটের অন্য শরীকদের যেভাবে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, সেইভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদেরকেও দেয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেন সাইফুল হক।

চলমান অবস্থা থেকে বাঁচতে, মানুষকে বাঁচাতে দেশের স্বার্থে সরকার ও বিরোধীদলকে তড়িঘড়ি করে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন। বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই