স্মরণশক্তি কমে গেলে কী করা উচিত?
বিস্মৃতি বয়স বৃদ্ধির একটি সাধারণ লক্ষণ। মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে যেভাবে দৈহিক পরিবর্তন হয় ঠিক তেমনি ধীশক্তিরও কিছু পরিবর্তন হয়। এর ফলে কিছু মানুষের নতুন কিছু শিখতে সময় লাগে, তারা পূর্বের মত তথ্য মনে রাখতে পারেনা অথবা তারা জিনিস হারিয়ে ফেলে যেমন- চশমা। এসব গুলোই হচ্ছে হালকা বিস্মৃতির লক্ষণ এবং এগুলো স্মরণ শক্তির মারাত্মক কোন সমস্যা নয়। কিছু বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা জটিল স্মৃতি বা লার্নিং টেস্টে তরুণদের চেয়ে ভালো করতে পারে না। যদিও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, পর্যাপ্ত সময় দিলে স্বাস্থ্যবান প্রবীণরা এই পরীক্ষাগুলোতে তরুণদের চেয়ে ভালো করে। আসলেই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক সামর্থ্য যেমন- শব্দ তালিকা উন্নত হতে থাকে।
স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার অন্য যে কারণ :
স্মরণশক্তির সমস্যা কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণেও হয়ে থাকে যার চিকিৎসা করা যায়, যেমন- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ভিটামিন বি ১২ এর ঘাটতি, দীর্ঘস্থায়ী অ্যালকোহল সেবন, মস্তিষ্কে টিউমার বা ইনফেকশন হলে বা মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধলে স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে বা ডিমেনশিয়া হতে পারে। থাইরয়েডের সমস্যা, কিডনি অথবা লিভারের সমস্যা থেকেও স্মৃতিবৈকল্যের সমস্যা হতে পারে। তাই এই ধরণের গুরুতর শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন।
মানসিক সমস্যা যেমন- স্ট্রেস, উদ্বিগ্নতা, ডিপ্রেশন ইত্যাদি মানুষকে অনেক বেশি ভুলোমন করে দিতে পারে যাকে ডিমেনশিয়া বলে ভুল হতে পারে। এই ক্ষেত্রে যারা সম্প্রতি অবসরগ্রহণ করেছেন অথবা যার জীবনসঙ্গী, আত্মীয় বা বন্ধু মৃত্যুবরণ করেছে তারা দুঃখিত, চিন্তিত, নিঃসঙ্গ বা উদাস অনুভব করে। জীবনের এই পরিবর্তন গুলোর কারণে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত ও বিস্মরণপ্রবণ হয়ে পরে।
আবেগ সংক্রান্ত কারণে যে বিভ্রান্তি ও বিস্মৃতির সৃষ্টি হয় তা অস্থায়ী এবং অনুভূতি গুলো ঝাপসা হওয়ার সাথে সাথে সমস্যাও দূর হয়ে যায়। এই মানসিক সমস্যাগুলো পরিবার ও বন্ধু বান্ধবের সহযোগিতায় সহজ হয়ে আসে। কিন্তু যদি এই অনুভূতিগুলো দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় তাহলে চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া প্রয়োজন।
আরো গুরুতর স্মরণ শক্তির সমস্যা :
কিছু বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে স্মরণশক্তির সমস্যা অনেক গুরুতর সমস্যার লক্ষণ। যারা স্মরণশক্তির কমে যাওয়ার কারণে চিন্তিত আছেন তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নের ব্যবস্থা করবেন। একজন স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই মূল্যায়নটি যথাযথ ভাবে করতে পারবেন। সম্পূর্ণ ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে এবং সেই মানুষটি সম্পর্কে সঠিক ভাবে সব তথ্য যেমন- তার পূর্বের অসুখের বিষয়ে, তার খাওয়া দাওয়া ও জীবনযাপন সম্পর্কে জানলেই সঠিক ভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব। এর জন্য চিকিৎসক রোগীর পরিবারের সদস্য বা কাছের বন্ধুর সাথে কথা বলবেন।
কিছু মানুষ Amnesic Mild Cognitive Impairment (MCI) সমস্যায় ভোগেন। তারা সমবয়সী মানুষের তুলনায় স্মৃতিভ্রংশের সমস্যায় ভোগেন বেশি। কিন্তু তাদের লক্ষণগুলো আলঝেইমার্স রোগীদের মত এত তীব্র নয় এবং তারা তাদের সাধারণ প্রাত্যহিক কাজ গুলো করতে পারেন। তারা প্রায়ই জিনিস হারিয়ে ফেলেন, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা ভুলে যান, কাঙ্ক্ষিত শব্দ ভুলে যান, পরিবার ও বন্ধুরা এগুলো বুঝতে পারেন। MCI সমস্যাটি যাদের আছে তার চেয়ে যাদের নেই তাদের আলঝেইমার্স হতে দেখা যায় বেশি। MCI এর মানসম্মত কোন চিকিৎসা এখনও নেই। চিকিৎসক নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন।
ডিমেনশিয়া :
ডিমেনশিয়া হলে চিন্তা, স্মৃতি ও যুক্তির দক্ষতা হ্রাস পায় যা ফলে সাধারণ দৈনন্দিন কাজ করতে সমস্যা হয়। ডিমেনশিয়া নিজে কোন অসুখ নয় বরং আলঝেইমার্স এর মত রোগের লক্ষণের সমষ্টি। যাদের ডিমেনশিয়া আছে তারা বিভিন্ন হারে মানসিক দক্ষতা হারায়। ডিমেনসিয়ার লক্ষণ গুলো হল –
· কিছু মনে করতে না পারা
· একই প্রশ্ন বার বার করা বা একই গল্প বার বার করা
· পরিচিত জায়গায়ও হারিয়ে যাওয়া
· নির্দেশনা অনুসরণ করতে না পারা
· সময়, মানুষ ও স্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হওয়া
· ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও পুষ্টি সম্পর্কে অবহেলা করা
ডিমেনশিয়ার দুইটি প্রধান ভাগ হচ্ছে আলঝেইমার্স রোগ ও ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া। এগুলোর কোন চিকিৎসা নেই। আলঝেইমার্স রোগ হলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের পরিবর্তনের ফলে বহু স্নায়ুকোষের মৃত্যু হয়। আলঝেইমার্সের লক্ষণ গুলো আস্তে আস্তে প্রকাশ পায় এবং স্নায়ু কোষের ক্ষতি বৃদ্ধির সাথে সাথে খারাপ ও অটল হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে চিন্তা করা, বিচার করা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের চিনতে পারা এবং দৈনন্দিন কাজ গুলো যেমন- ড্রাইভিং করা, টাকার হিসাব রাখা ইত্যাদি সঠিক ভাবে করার ক্ষমতা কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তার সার্বিক যত্নের প্রয়োজন হয়।
ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া হলে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহে পরিবর্তনের ফলে মস্তিষ্ক টিস্যুর মৃত্যু ঘটে। ভাস্কুলার ডিমেনশিয়ার লক্ষণ গুলো হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোথায় স্ট্রোক হয়েছে ও কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার উপর। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতি, ভাষা, যুক্তি এবং সমন্বয়ের উপর প্রভাব পরে। মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়। স্ট্রোকের ফলে যে ক্ষতি হয়ে যায় তা আর সারানো যায়না। তাই স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসা নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। পরবর্তীতে যেনো আর স্ট্রোক না হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে একজন চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। পরিবারের সদস্যরা ও বন্ধুরা তার প্রাত্যহিক কাজ, শারীরিক কর্মক্ষমতা ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন। তিনি যেন তার পারিপার্শ্বিক সব খবরাখবর পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া স্মৃতি উপকরণ সাহায্য করতে পারে, সেক্ষেত্রে দিনের পরিকল্পনা বা কোন জিনিস কিভাবে ব্যবহার করতে হয় লিখে রাখুন।
স্মৃতি শক্তির তীক্ষ্ণতা বাড়ানোর জন্য যা যা করা যায় :
· কাজের পরিকল্পনা করুন ও লিখে রাখুন নোট বুক বা ক্যালেন্ডারে।
· শখের বিষয় গুলোতে যুক্ত থাকার চেষ্টা করুন যা শরীর ও মন উভয়কেই সাহায্য করবে।
· শারীরিক কর্মকাণ্ড ও ব্যায়াম করুন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্যায়াম যেমন- হাঁটা, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
· অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন করলে স্মৃতি ধ্বংস ও মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হয়। তাই অ্যালকোহল সেবন বাদ দিন।
· স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যায়াম বা শখের কাজ খুঁজে বের করুন। যদি এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন নিরাময়ের পদক্ষেপ নিন।
রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক ডিমেনশিয়ার কারণ খুঁজে বাহির করবেন। এছাড়াও স্মৃতিভ্রংশের পরীক্ষা, সমস্যা সমাধান করতে পারার পরীক্ষা ও ভাষার ক্ষমতা পরীক্ষা করবেন এবং ব্রেইন স্ক্যান- MRI করলে স্মরণ শক্তির সমস্যার কারণ নির্ণয় করা সহজ হয়।
মন্তব্য চালু নেই