স্বপ্নের পদ্মা সেতু : ভিটেমাটি হারিয়েও তারা খুশি
চলছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের কাজ। তাই পদ্মাপাড়সহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে উৎসাহ আর উদ্দীপনার কমতি নেই। পদ্মায় মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ায় মাদারীপুরের শিবচর, শরিয়তপুরের জাজিরা আর মুন্সীগঞ্জের মাওয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন মহাখুশি।
দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও এর সংশ্লিষ্ট কাজ শুরু হওয়ায় ওই অঞ্চলের মানুষ এখন প্রতীক্ষায় আছে কবে ফেরি আর স্পিটবোট ছেড়ে সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করবে। যাইহোক, নানা জটিলতার পর অবশেষে ভেঙে যেতে থাকা তাদের স্বপ্নে আবারও পূর্ণ প্রাণসঞ্চার হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে পদ্মা সেতু এখন আর খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হবে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর।
সরেজমিনে শিবচরের মাদবরেরচর, বাখরেরকান্দি, কাওড়াকান্দি, কাঁঠালবাড়ী এলাকায় ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো তাদের ইতিবাচক নানা মন্তব্য। দেখা গেছে তাদের উচ্ছ্বাস, উৎসাহ আর উদ্দীপনা।
দিনের কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে এলাকাবাসীর অনেকেই বের হচ্ছেন পদ্মা সেতুর বিশাল এই কর্মযজ্ঞ দেখতে। শুধু স্থানীয়রা নয়, উৎসুক জনতা দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন পদ্মা পাড়ে। চোখ বুলাচ্ছেন তাদের স্বপ্নের সেতু নির্মাণের এই ব্যস্ততায়। যারা পদ্মা সেতুর জন্য নিজেদের বসতবাড়ি, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তারাও এখন মহাখুশি। প্রকাশ করছেন ইতিবাচক নানা প্রতিক্রিয়া। তাদের প্রত্যাশা শুধু একটাই, স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
সূত্র জানায়, বহুল পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পুরোদমে চলছে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের কাজ। পদ্মা বহুমূখী সেতু প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত সব জমি চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর হস্তান্তর করা হয়েছে মূল সেতুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের কাছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের যাবতীয় কাজ শেষ করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত দিনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারলে পরবর্তী প্রতি দিনের জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ বাবদ সেতু কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে মূল সেতুর জন্য নির্ধারিত জমি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের খবর স্থানীয়দের কাছে পৌঁছে গেলে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। চোখে-মুখে ফুটে উঠে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সম্ভাবনাময় প্রাপ্তি।
এদিকে শিবচরের পাঁচ্চর থেকে কাওড়াকান্দি হয়ে কাঁঠালবাড়ী ঘাট পর্যন্ত পদ্মা পাড়জুড়ে রয়েছে সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় মালামাল। আর মাওয়া পাড় ও নদীতে রয়েছে ভারী যন্ত্রপাতি। উভয় পাড়ের নদীতীরে নির্মাণ করা হয়েছে কংক্রিটের স্থাপনা।
এসব যন্ত্রপাতি ও সংশ্লিষ্ট কাজ তদারকির জন্য যারা রয়েছেন, তাদের জন্য পদ্মা পাড়েই নির্মাণ করা হচ্ছে আবাসস্থল।
সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা বহুমূখী সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থায়নে। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে করা হয়েছে নকশা প্রণয়ন। তাছাড়া মূল সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি হয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে।
কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রকল্পে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে দাতা সংস্থাগুলো অর্থায়নের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়। ফলে পদ্মা সেতু তৈরি নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা।
অবশেষে নানা নাটকীয়তা ও জটিলতা নিরসন শেষে আলোর মুখ দেখে দেশের এই বৃহত্তম সেতু প্রকল্প। যা এখন বাস্তবায়নের পথে।
সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজের পাশাপাশি জাজিরা অংশে ১২ কিলোমিটার এবং মাওয়া অংশে সাড়ে তিন কিলোমিটার সেতু সংযোগের সড়ক নির্মাণের কাজও চলছে পুরোদমে। উভয় পাশের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হবে বলে সংযোগ সড়ক নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা জানান।
সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ সূত্র আরও জানায়, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ২২ হাজার ৮৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে রেলপথসহ মূল সেতু নির্মাণের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নদী শাসনের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তির পরিমান ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের ব্যয় ১ হাজার ২৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এবং নির্মাণকাজ তদারকি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে মোট ৫১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর সার্ভিস এরিয়ার জন্য ব্যয় হচ্ছে ২০৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
৪২টি পিলারের উপর ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের দ্বিতল বিশিষ্ট সর্ববৃহৎ এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। উপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর নীচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য গত জুনে চীনের ‘চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগ দেয়া হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে নির্মাণ যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। মূল সেতুর চুক্তি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
এর আগে ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রথম ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। পরবর্তিতে ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে এখনো ২০১১ সালে অনুমোদিত ব্যয়ই বহাল রয়েছে। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি ভৌত ও একটি পরামর্শক সংক্রান্ত। ভৌত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল সেতু, নদী শাসন, দুইপাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ।
৫টি ভৌত ও দুটি তদারকি প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর সাথে নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট স্থানান্তর ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যয় ধরলে ব্যয় হবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র আরও জানায়, পদ্মা সেতুর ২৬৪ টি পাইল হবে এর মধ্যে ২৪০ টি হবে স্টীলের বাকী ২৪টি কংক্রিটের, প্রতিটি পাইলের পরিধি হবে ৩ মিটার ও মাটির ১১৪ থেকে ১২০ মিটারে তা স্থাপন করা হবে। সেতুর স্প্যান হবে প্রতিটি ১৫০ মিটার করে ৪১টি। নদীর পানির স্তর থেকে ব্রিজের সর্বনিম্ন উচ্চতা থাকবে ১৮ মিটার।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদারদের পাওনার সিংহভাগই ডলারে পরিশোধ করতে হয়। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রায় ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অগ্রণী ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার যোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
পদ্মা প্রকল্পের আওতায় প্রাক্কলিত অন্যসব ব্যয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ জাজিরা অ্যাপ্রোচ সড়কে ১ হাজার ৯৮ কোটি টাকা, দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মাওয়া অ্যাপ্রোচ সড়কে ব্যয় হচ্ছে ১৯৩ কোটি টাকা এবং সার্ভিস এরিয়া বাবদ ২০৯ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য মুন্সীগঞ্জ, শরিয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাক্তিদের পূনর্বাসনের জন্য প্লট তৈরি করা হয়েছে ২ হাজার ৫৯২ টি। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর মাওয়া অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে মাওয়া ফেরিঘাট শিমুলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম কাউন্টডাউনের চিঠি দিয়েছেন মূল সেতুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে। চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ওই চিঠি গ্রহণ করে জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা সেতুর সব কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২০১৮ সালে যাতে এই সেতু দিয়ে পরিবহন চলতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সকল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক জিএসএম জাফর উল্লাহ বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ৮ ডিসেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওই দিনে শুরু হয়ে গেলো মূল সেতু নির্মাণের কাজ। দায়-দায়িত্ব চলে আসায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।’
মন্তব্য চালু নেই