স্কুলছাত্রীর সন্তান প্রসব নিয়ে তোলপাড়!

তেরো বছরের কিশোরী। পড়ে ৭ম শ্রেণিতে। চোখে, মুখে এখনও কৈশোরের দুরন্তপনা।

জীবনের অনেক কিছুই জানা হয়নি তার। কিন্তু এরই মধ্যে তার কোলে এসেছে একটি পুত্র সন্তান। পরিচিতি পেয়েছে কিশোরী মাতা হিসাবে। সন্তান জন্ম দেয়ার ঠিক আগের দিনও সে স্কুলে গিয়েছিল।

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তোলপাড় চলছে পুরো এলাকায়। বিষয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়িয়ে এখন আইনের আওতায়।

এতে চরম ক্ষুদ্ধ এলাকার মাতব্বরদের একটি অংশ।

ফলে প্রচণ্ড চাপের মুখে কিশোরী মাতার পরিবার। সামাজিকভাবে বয়কট, একঘরে করারও হুমকি দেয়া হচ্ছে।

মামলার বাদী ও অভিযুক্তদের আর্থ সামাজিক অবস্থার মধ্যে বিশাল ফারাক। ভিকটিমের পরিবার হতদরিদ্র। অন্যদিকে অভিযুক্তরা এলাকার প্রভাবশালী।

মামলার প্রধান আসামি প্রবাসী বাবুল আহমদ সম্প্রতি দ্রুত দেশত্যাগ করেছেন চুপিসারে। সন্তান প্রসবের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী প্রবাসী পরিবারের ৪ জনকে দায়ী করছেন কুমারী মাতা।

এ সংক্রান্ত লিখিত অভিযোগ থানায় নিয়ে যান ভুক্তভোগীরর মা। তবে অভিযোগ নেয়নি কানাইঘাট থানা পুলিশ।

পরে একই অভিযোগ নিয়ে গেলে মামলা রেকর্ড ও তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। নির্দেশের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রেকর্ড করে কানাইঘাট থানা।

মামলায় আসামি করা হয়েছে, কানাইঘাট উপজেলার পশ্চিম দর্পনগর কোণাগ্রামের জামাল উদ্দিনের তিন পুত্র যথাক্রমে মো. বাবুল আহমদ, দুলু মিয়া ও ফারুক মিয়া এবং বাবুলের স্ত্রী শিফা বেগমকে। তবে এই মামলা রেকর্ডের পর অভিযুক্তরা এখন আরও বেপরোয়া।

তারা মামলার বাদীপক্ষ ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।

কিশোরীর সন্তান প্রসবের জন্য তারা দায়ী নয় বলেও দাবি করেছেন অভিযুক্তরা।

এই ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার পশ্চিম দর্পনগরের পূর্ব কোণাগ্রামে। গত ২০অক্টোবর পুত্র জন্ম দেন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী মেয়েটি।

মামলার ভাষ্য অনুযায়ী, পাশের বাড়ির জামাল উদ্দিনের পুত্র বাবুল মিয়া ১৫/১৬ বছর ধরে সৌদি আরবে আছেন। ২/১ বছর পর পর দেশে আসেন আবার চলে যান। প্রায় আড়াই বছর আগে দেশে আসে বাবুল। আসার পর ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী মেয়েকে তার বাড়িতে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের কাছে রেখে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। নিজের বোনের মতো ভরণ-পোষণ, লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেন বাবুল। এতে আশ্বস্ত হয়ে বাবুলের বাড়িতে দেয়া হয় স্কুল পড়ুয়া শিশুকন্যাকে। এদিকে প্রায় আড়াই বছর পর গত ১৭ মার্চ দেশে আসেন বাবুল। এরপর তিনি কানাইঘাটের গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করেন। বাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় প্রতি রাতেই কিশোরী মেয়েটিকে নির্যাতন করতেন বাবুল।

এমন অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি আত্মীয়স্বজন ও মুরুব্বীদের জানানো হয়। তারা সালিশে বিষয়টির সমাধান করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু সালিশের আগেই চুপিসারে দেশত্যাগ করেন বাবুল।

স্থানীয় ও ভুক্তভোগীর পরিবার জানায়, গত ২০ অক্টোবর ভোররাত কিশোরী মেয়েটির ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় বাবুলের পরিবারের লোকজন। তাদের মারধোর সহ্য করতে না পেরে নিজ বাড়িতে চলে আসে ওই কিশোরী। কিছুক্ষণ পর তার প্রসব বেদনা উঠে এবং পুত্র সন্তান জন্ম হয়।

প্রথমে কানাইঘাট স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেলে তাকে ওসমানী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসার পর সন্তানসহ কিশোরী মাতা এখন কানাইঘাটের গ্রামের বাড়িতে।

ভুক্তভোগীর ভাই বলেন, আমার কিশোরী বোনকে বিয়ের কথা বলে ধর্ষণ করত প্রবাসী বাবুল। এর ফলে আমার বোন গর্ভবতী হয়ে পড়লে বাবুল গোপনে বিদেশ পালিয়ে যায়। সে চলে যাওয়ার পর মারধোর করে, ওষুধ খাইয়ে সন্তান নষ্ট করতে চায় তার পরিবারের লোকজন। তাদের মারধোরেই মাত্র সাড়ে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমার বোন সন্তান প্রসব করে। এখন আমাদের পুরো পরিবার ও মামলার সাক্ষীরা হুমকির মধ্যে আছি। আমাদেরকে একঘরে, সমাজচ্যুত করার হুমকিতে রয়েছি আমরা। এর আগেও আমার পিতাকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। অথচ আমার দাদা নাসির উদ্দিন কোণাগ্রাম মসজিদের ভূমি দাতা।

এ বিষয়ে স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এধরণের কিছু প্রচার না করাই ভাল। তার মতে বিষয়টি সালিশে সমাধান করে নিলেই ভাল হত।

স্থানীয় ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন বলেন, কিশোরীর সন্তান প্রসবের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় চলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা ছিল। এখন যে পর্যায়ে গেছে তা আর সালিশের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য বলে মনে হয় না। আইনিভাবেই বিষয়টির সমাধান করতে হবে।

মামলায় আসামি ও বিদেশ পালানো বাবুলের ভাই দুলু মিয়া বলেন, আমার মায়ের দেখাশোনার জন্য কিশোরী মেয়েটাকে রাখা হয়েছিল। হঠাৎ সে সন্তান জন্ম দেয়। সৌদি প্রবাসী আমরা ভাই বাবুলের সাথে যোগাযোগ করলে সে কসম করে বলেছে এই সন্তান তার নয়। সে দেশে ফিরলে ডিএনএ পরীক্ষা করলে বুঝা যাবে আসলে সন্তানটি কার। সন্তান তার হয়ে থাকলে ক্ষতিপূরণ, দায়দায়িত্ব নিতেই হবে।

কানাইঘাট থানার ওসি মো. হুমায়ুন কবির জানান, ইতিমধ্যে ২২ ধারায় ভুক্তভোগী জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

বাদীর এজাহার মামলা হিসাবে গ্রহণ না করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে ওসি বলেন, আদালতে মামলা করতে গেলে পুলিশের বিরুদ্ধে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন।



মন্তব্য চালু নেই