সেই হিসাব না মেলায় খালেদা জিয়ার ফিরতে দেরি!

এনাম আবেদীন : পাঁচ সপ্তাহেরও বেশি হয়ে গেল চোখের চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া লন্ডনে। অথচ তিনি কবে দেশে ফিরবেন- এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। ঢাকার অধিকাংশ নেতাই এ ব্যাপারে একেবারে অন্ধকারে। ফলে বিএনপির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আরো অনেক জায়গায় এখন নানা আলোচনা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। সবার মনে একই কৌতূহল ও প্রশ্ন- কী হচ্ছে লন্ডনে? ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও কৌশল নিয়ে মা ও ছেলের মধ্যে এখনো হয়তো কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আবার দলের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে মা ছেলেকে কতটা ছাড় দিতে পারবেন বা ছেলে মাকে কী দেবেন- সংশ্লিষ্ট মহলে এমন আলোচনাও বেশ জোরদার এখন। বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহলের ‘ইচ্ছা’ অনুযায়ী ক্ষমতায় যাওয়ার শর্ত হিসেবে বিএনপিকে এবার বেশ কিছু ইস্যুতে ‘ছাড়’ দিতেই হবে; যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দলে তারেক রহমানের প্রভাব ভবিষ্যতে বাড়বে, নাকি কমবে সে প্রশ্নের মীমাংসা। যদি তারেকের ক্ষমতা বাড়ে, সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার কাজের চাপ আগের চেয়ে কমে যাবে। আর যদি ছেলের ক্ষমতা খর্ব হয়, তাহলে দলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে চেয়ারপারসনের। এটা হবে দলের জন্য তারেকের বড় ‘ছাড়’। ছেলের সঙ্গে ‘হিসাব’ না মেলায় খালেদার ফিরতে দেরি! ঢাকায় এবং লন্ডনে একাধিক জায়গায় গতকাল শুক্রবার যোগাযোগ করে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার দিনক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন একমাত্র আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। কয়েক দফা চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ঢাকায় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানসহ একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার ফিরে আসার সময়সূচি সম্পর্কে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে তাঁরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট চোখের চিকিৎসক অনুমতি দিলেই তিনি ফিরে আসবেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে গত ১৭ অক্টোবর দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি প্রতিবেদককে জানান, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ক্লিয়ারেন্স দিলেই চেয়ারপারসন দেশে ফিরবেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আর ফিরবেন না বলে যাঁরা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত ও আলোচনাই এ মুহূর্তে বিএনপিতে বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির স্থায়ী কমিটির অন্তত দুজন নেতা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, শুধু চিকিৎসার বিষয় হলে চেয়ারপারসনের ফেরার বিষয়টি নিয়ে এমন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হতো না। তাঁদের মতে, সাংগঠনিক বিষয় কিংবা জোটের পরিধি বাড়ানোর মতো অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এত সময় লাগার কথা নয়। রহস্য কিছু একটা আছে; আর অবশ্যই সেটি মা ও ছেলের মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়াসংক্রান্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়। সম্ভবত তাঁদের ‘ইকুয়েশন’ এখনো মেলেনি; যোগ করেন ওই নেতারা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথমে কিছুদিন হোটেলে, তারপর তারেক রহমানের বাসায় থাকলেও এখন কিংস্টনে বাসা ভাড়া নিয়ে আলাদা থাকছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। লন্ডনের একটি সূত্র জানিয়েছে, কিংস্টনে তারেকের বাসা ছোট হওয়ায় কিছুদিনের জন্য একই এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পর্যবেক্ষক মহলের পাশাপাশি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ নেতাও মনে করেন, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে এবারের এই লন্ডন সফরের ওপর। অর্থাৎ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা বা সমঝোতার ওপর এবং দৃশ্যত চোখের চিকিৎসার সুযোগ কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়া যে মূলত তাঁর ছেলের সঙ্গে আলোচনা করতে গেছেন এটি তাঁদের প্রায় সবারই জানা। দলটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে আরো জানা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর- এটিও বিএনপি নেতারা জানেন। বিশেষ করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ এ ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি বলে পরিচিত। ফলে ওই দেশগুলো কী চায় তার হিসাব-নিকাশের সঙ্গে লন্ডন সফরকে যুক্ত করা হচ্ছে। কেউ বলছেন, ভারত অন্তত ১০ বছরের জন্য তারেক রহমানকে বিএনপির রাজনীতি থেকে বাইরে রাখার পক্ষে। বিশেষ করে দলটি ক্ষমতায় এলে তারেকের যাতে সরকারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে এটি ভারত নিশ্চিত করতে চাইছে। পাশাপাশি বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ারও পরামর্শ দিচ্ছে তারা। দলীয় নেতাদের এ অংশের যুক্তি হলো, ভারতের সঙ্গে নানা কারণে তারেক রহমানের অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁকে ‘বাদ’ দেওয়ার জন্য বিএনপিকে দেশটি একরকম চাপে ফেলেছে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, এ ধরনের শর্ত পূরণ হলে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দেবে বলে ভারত আশ্বস্ত করছে বিএনপিকে। এদিকে দেশে-বিদেশে তারেক রহমানেরও একটি সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের হিসাব ও যুক্তি হলো, বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে তারেকেরও যোগাযোগ রয়েছে। তারা ভারতের নিরাপত্তা প্রশ্নে কিছু ইস্যুতে সমঝোতা চাইলেও রাজনীতি থেকে তারেকের বিদায় চাইছে- বিষয়টি এমন নয়। এটি দলের ভেতরে ও বাইরে তারেকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে তারা মনে করে। সব মিলিয়ে লন্ডন সফরকে কেন্দ্র করে তাই ঢাকায় এখন সর্বশেষ আলোচনা হলো, বিদেশিদের দেওয়া শর্ত নিয়ে এখনো মা-ছেলের মধ্যে সমঝোতা হয়নি। অর্থাৎ একমত হতে পারেননি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তাই খালেদা জিয়ার দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে বিএনপি নেতারা মনে করছেন। তবে দলটির শীর্ষ দুই নেতার মধ্যকার স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে তাঁরা একেবারেই রাজি নন।-কালেরকণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই