সুন্দরবনে মহামারীর আশঙ্কা
ভয়াবহ সঙ্কটে পড়ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। ট্যাংকার দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে এরই মধ্যে বিবর্ণ হতে শুরু করেছে বনের গাছপালা। ফার্নেস অয়েলের প্রভাবে শ্বাসমূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নষ্ট হতে চলেছে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানি ও খাদ্যের সঙ্কট। ফলে মারা যাচ্ছে অসংখ্য পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র্য। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে, সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি হারিয়ে যেতে পারে চিরতরে। যেগুলো বেঁচে থাকবে তাদের মধ্যেও নানা রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনে মহামারীর আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘের সাবেক পরিবেশ ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও প্রাণিবিজ্ঞানী ড. এনআই খান ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, বিশিষ্ট প্রাণ ও প্রতিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ, বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল এমন আশঙ্কার কথা জানান।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোরে সুন্দরবন এলাকার শ্যালা নদীতে ‘ওসি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের ফার্নেল ওয়েলবাহী একটি ট্যাংকার ডুবে যায়। এসময় ট্যাংকারের তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল পরিমাণের এই ফার্নেস অয়েল শ্যালা, পশুর ও বলেশ্বর দিয়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
মহামারীর আশঙ্কা:
ফার্নেস অয়েলের ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. এরআই খান বলেন, ‘এটা সাধারণ তেল নয়। ক্ষতিকর একটি বিষাক্ত পদার্থ। এই তেল সুন্দরবন এলাকার শ্যালা, পশুর ও বলেশ্বর নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। অথচ এই নদীর পানি পান করে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, বানরসহ অন্যান্য প্রাণী বেঁচে থাকে। তারা এখনো বাধ্য হয়ে এই পানি পান করে। এর ফলে চর্মরোগসহ পাখিগুলো বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। একটি প্রাণী থেকে তা অন্য সব প্রাণীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। পরিস্থিতি মহামারী আকার ধারণ করতে পারে, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
অতিথি পাখি আসবে না:
ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল ইতিমধ্যে সুন্দরবনের মাটি, গাছের পাতা ও শ্বাসমূলে আস্তর করে ফেলেছে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দরবনে পাখি আসে। গরম এলে চলে যায়। পাখিগুলো খাদ্য আহরণের সময় তেলের ভারি আস্তর তাদের পাখায় লেগে যায়। ফলে পাখাগুলো অনেকটা ভারি হয়ে পড়ে। তারা উড়তে পারে না। ক্লান্ত হয়ে মাটিতে নেমে পড়বে। তখন তারা আর নিরাপদ থাকবে না।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের সাবেক এই প্রাণী বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভয়াবহ এ বিপর্যয়ের কারণে যে রাজহাস সাদা ছিল সেটা কালো হয়ে গেছে। বহু পাখি বিবর্ণ হয়ে গেছে। পাখিরা নিজেকে নিরাপদ মনে না করলে তখন আর কেউ ফিরে আসবে না।’
ধ্বংস হবে ইরাবতি ডলফিনের অভয়াশ্রম:
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ইরাবতি ডলফিনের অভয়াশ্রম। কিন্তু ফার্নেল অয়েলবাহী ট্যাংকারের দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে ওই এলাকায় ডলফিন দেখা যায়নি। ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর পর ডলফিন শ্বাস নিতে ভেসে ওঠে। কিন্তু পানিতে তেলের মোটা আস্তর পড়ে যাওয়ায় তারা এখন শ্বাস নিতে পারছে না। সূর্যে্যর আলোও পানির মধ্যে যাতে পারছে না। ফলে পানিতে অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দেয়। এজন্য হয়তো ডলফিনগুলো অন্যত্র চলে গেছে।
এ বিষয়ে বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘ইরাবতি ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর প্রাণী। তেল দুর্ঘটনার কারণে দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রভাব পড়বে। তারা খাবার ও অক্সিজেন নিতে পারবে না। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দিক পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। এর কারণে আমরা তাদেরকে মূলত বাস্তুহারা করলাম। ফলে আমরা এদের চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারি। এ কারণে বহু মাছও মেরে গেছে।’
হারিয়ে যাবে বাঘ:
বাঘ কিন্তু শুধু বাঘ না। সে সুন্দর বনের অতন্দ্র পহরী। বাঘের কারণে বনের প্রকৃতি রক্ষা পাচ্ছে। ভয়ে কেউ বন উজাড় করতে আসে না। বাঘ ও সাপ না থাকলে সুন্দরবনের অবস্থা অরক্ষিত হয়ে পড়তো। ধীরে ধীরে বনভূমি উজাড় হয়ে যেতো। কিন্তু এই বাঘের আবাসস্থল এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছে।
ড. এনআই খান ও শরীফ জামিল বলেন, ‘এমনিতেই এ অঞ্চলের বাঘ বয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। ২০১২ সালে সুন্দর বনের বাঘ গণনায় বর্তমানে সুন্দরবনে ৪৪৪টি বাঘ থাকার কথা। এদের ৬৩ ভাগ শ্যালা নদীর তীরবর্তী বন থাকে। যারা ওই নদীর পানি পান করে। কিন্তু নদীর পানিতে তেলের আস্তর পড়ায় বাঘ পানি পান করতে আসছে না। নীরাপদ পানির কারণে তারা মারা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি বাঘ এরই মধ্যে মারা গেছে।’
বিবর্ণ হতে শুরু করেছে বনাঞ্চল:
শ্বাসমূলের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়েই অক্সিজেন নেয় সুন্দরবনের বৃক্ষ। কিন্তু ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে ছিদ্রগুলো ঢাকা পড়েছে। এ দিয়ে অক্সিজেন নিতে পারছে না। এ কারণেই বনের গাছ-গাছালি বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। গাছের পাতার সবুজ আভা কমে ফ্যাকাশে ও হলুদবর্ণ হচ্ছে। কিছু কিছু গাছ জীর্ণ হয়ে শুকিয়ে গেছে। মৃত কাঁকড়া চোখে পড়লেও জীবন্ত কোনো জলজ প্রাণী ও পাখির অস্তিত্ব বনের চারপাশে দেখা যায় না।
শরীফ জামিল জানান, তেলের গ্যাসের কারণে গাছগুলো আস্তে আস্তে জীর্ণ হয়ে মরে যাবে। একটি গাছ অসুখ হলে তা সিমাবদ্ধ থাকবে না। ইকো সিস্টেমের মতো তা অন্যান্য গাছেও ছড়িযে যাবে। তখন বাকিগাছগুলেও মরে যাবে।
এই পরিবেশবাদীরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এর আগে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে যানবাহন চলবে না। কিন্তু তার সে নির্দেশ নৌমন্ত্রী মানেন নি। তিনি অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। যেখানে চেইন অব কমান্ড নেই সেখানে তো এমন ঘটনা ঘটবেই।’
জানা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়নি বনবিভাগ:
সুন্দরবনে তেল দূষণের ফলে কী ক্ষতি হতে পারে তা জানা ছিল বনবিভাগের। এ নিয়ে ২০০১ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে বন বিভাগ। গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবন এলাকায় যেকোনো ধরনের তেলবাহী ট্যাংকারের দুর্ঘটনা ঘটলে তেলের আবরণের ১৫ দিনের মধ্যে সুন্দরবনের গেওয়া ও সুন্দরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের শেকড়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধা দেবে। শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়াসহ অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাছের ডিম পাড়া এবং বিচরণ বাধাগ্রস্ত হবে। পাখির মৃত্যু ঘটবে বেশি। দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিগ্রস্ত হবে হরিণ, বাঘ, ডলফিন, তিমি ও ভোঁদড়সহ অন্যান্য প্রাণী।
এমন তথ্য দিয়ে বিশিষ্ট প্রাণ ও প্রতিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘বন বিভাগের কাছে এমন একটা প্রতিবেদন থাকলেও তারা দুর্ঘটনার তিনদিন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর মধ্যামে সরকার প্রমাণ করেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটি বাংলাদেশের প্রথম আগ্রহের জায়গায় অনুপস্থিত।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এর প্রভাবে দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবনের আয়তন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। উদ্ভিদ ও প্রাণী বিন্যাসের একটা পরিবর্তন ঘটবে। প্রাণিকুলের ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে।’
ক্ষতি হবে এলাকাবাসীরও:
সুন্দরবনের আশপাশে হাজার হাজার মানুষের বসবাস। এই বন ঘিরে থাকা নদীগুলোর ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবন-জীবিকা চলে। এরই মধ্যে নদীতে মাছ কমে গেছে। ফলে তাদের জীবনে বিপর্যয় অনিবার্য। তাছাড়া পানি থেকে তেল সরাতে এলাকার শতশত মানুষ কাজ করছে। এর কারণেও তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘সুন্দরবনের এ বিপর্যয়ের ফলে শুধু পরিবেশের নয়, ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। কাদা কাটি থেকে তেল সংগ্রহ করতে দিয়ে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েলের কারণে চর্মরোগের পাশাপাশি তারা পেটের পীড়ার আশঙ্কা রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বিপর্যয়ের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে না হলেন দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়বে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে অতিদ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। জীববৈচিত্র্যের সমাহার থাকায় এর নাম সুন্দরবন। নচেৎ কেউ একে সুন্দরবন বলতো না।’
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বাংলাদেশ:
ইউনেস্কোর ওয়াল্র্ড হেরিটেজ ঘোষণায় সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলা হয়েছে। ১৯৯২ সালের ইরানের রামসা কনভেনশনে জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রতিটি দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ সেখানে অংশ নেয়। কিন্তু সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি।
ড. এনআই খান জানান, এর আগে ইউনেস্কো বাংলাদেশের সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন দেশের স্বার্বভৌমত্বের কথা বলে তা দেয়া হয়নি। তারা যদি এর দায়িত্বে থাকতো তাহলে আজ সুন্দরবনের এমন দশা হতো না।
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন শুধু গাছের সমাহার নয়। ওই অঞ্চলের বহু নদী, নালা, খাল, বনলতা, কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র্যের সমাহার। কাজেই এখানে যে ঘটনা ঘটেছে তা এই স্থানটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা একে রক্ষা করতে বর্থ হয়েছি। এটা ক্ষমতাহীন অপরাধ। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
মন্তব্য চালু নেই