মরিয়া ভাবমূর্তি ফেরাতে

সিটি নির্বাচনের অনিয়ম স্বীকার করলো ইসি!

সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি নির্বাচনের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনও (ইসি) অসস্তোষ প্রকাশ করেছে। নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না বলে স্বীকার করেছেন নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টরা।

অতিসম্প্রতি (২১ মে, বৃহস্পতিবার) মাগুরা-১ আসনের উপ-নির্বাচন নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে সিটি নির্বাচনের বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় এলে এমন মন্তব্য উঠে আসে।

অনেক নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংগঠন, পর্যবেক্ষক সিটি নির্বাচনকে ঘিরে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মন্তব্য ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইসি বরাবরের মতো নির্বাচনকে অবাধ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করে আসছে। প্রকাশ্য বা গণমাধ্যমের সামনে তাদের কোনো ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।

সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে মাগুরা উপ-নির্বাচন নিরপেক্ষ করে আস্থা ও ভাবমূর্তি ফেরাতে মরিয়া ইসি। আর এ কারণেই এ উপনির্বাচন সংক্রান্ত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বৈঠকে সিটি নির্বাচনে অনিয়ম তুলে ধরে সবাইকে সতর্ক করা হয়।

বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, কয়েকজন কমিশনার সিটি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো কোনো সময় তাদের যথার্থ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বলেও অভিযোগ করেছেন।

সিটি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক বৈঠকে বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের দিন সুরিটোলা স্কুলের বেঞ্চ ভাঙা হচ্ছে, ব্যালট বক্স ভাঙা হচ্ছে। অথচ সেখানে স্থাপিত অপর দুটি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। সেই ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় কীভাবে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া পরবর্তীতে এ ঘটনা নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে বৈঠকে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সভার কার্যকারিতা নিয়ে আব্দুল মোবারক বলেন, ‘এ কারণে ইতোপূর্বে সব নির্বাচন উপলক্ষে যে আইনশৃঙ্খলা সভা হতো এ সভাটি যেন এ রকম না হয়। সকল গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে নিয়শ্চয়তা যেন থাকে।’

ভোটের অনিময় নিয়ে আব্দুল মোবারক আরও বলেন, ‘এছাড়া দেখা গেছে কোনো কোনো কেন্দ্রে অস্বাভাবিক মাত্রায় ভোট পড়েছে। সেখানকার আনসার, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এ ধরনের বিষয় নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের সুরিটোলা স্কুলের মতো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ ব্যাপারে সবাইকে ঠিকঠাক ও সময়মত রিপোর্ট দিতে বলেন এই কমিশনার।

বৈঠকে মাগুরা উপ-নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীতা তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘একটি আসন নির্বাচনের জন্য যদি অধিক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজন হয়, ভবিষ্যতে সব আসনের নির্বাচন করতে আমাদের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে।’

তিনি সিটি নির্বাচনে উদাহারণ তুলে ধরে বলেন, ‘সদ্য সমাপ্ত হওয়া সিটি নির্বাচনে অধিক সংখ্যক ফোর্স মোতায়েন করেও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে এবং আশানুরুপ ফল পাওয়া যায়নি। কাজেই কলেবর করে লাভ নেই। কাযকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে।’

এসময় নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, ‘আমাদের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিদেশে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু দেশের ভিতরে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সে সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।’

নোয়াখালী, চাঁদুপর, লক্ষ্মীপুর উপজেলা নির্বাচনে গোলোযোগের কথা তুলে ধরেন তিনি বলেন, ‘এ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক গোলযোগ হয়েছে। এখানে পুলিশ যথাযথ তৎপর থাকলে এ ধরনের গোলযোগ নাও হতে পারতো। সদ্য সমাপ্ত হওয়া সিটি নির্বাচনে যথেষ্ট ফোর্স দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি কেন্দ্র আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হয়নি।অধিকাংশ কর্মকর্তাই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন কিন্তু কতিপয় লোকের গাফিলতির কারণে সব আয়োজন ভেস্তে যায়।’

সবার আলোচনা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সিটি নির্বাচন নিয়ে অনেক অনেক ঘটনার কথা বলেছেন। ভালো কাজ করলেও সামান্য কিছু ঘটনার কারণে সবাইকে বদনামের ভাগি হতে হচ্ছে। সিটি নির্বাচনে আইনশঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট পরিমাণে নিয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু তাদের সকলের কার্যক্রম ও তৎপরতা যথাযথ ছিল না। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল কিন্তু সেই অস্ত্র তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে ভোট স্টাফিং (vote stuffing) এর মতো কোনো ঘটনা ঘটত না।’

মাগুরা নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে যেসব পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে তাদের একজনকে ভোটকেন্দ্রে চৌহদ্দিতে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দায়িত্বপালন করবে। অপর একজন বুথে প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করবে। যাতে কোন ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।’

উল্লেখ্য,২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জালভোট, সংর্ঘষ ও নানা অনিময়ের অভিযোগ আসে, এগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়। এমনকি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোটগ্রহণের মাঝপথে বিএনপিসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনও সিটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

যদিও ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (স্পেশাল ব্রাঞ্চ), আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক, মাগুরার জেলা প্রশাসক, মাগুরা পুলিশ সুপার, মাগুরা-১ আসনের রিটার্নিং অফিসারসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।



মন্তব্য চালু নেই