সাত বছরে ১৭৬ কিলোমিটার রেলপথে ঝরেছে দুই হাজার প্রাণ
বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব অংশ টাঙ্গাইল থকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের দূরত্ব ১৭৬ কিলোমিটার। এই রেললাইনটি ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকার আওতায়। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত বছরে এই রেললাইনে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৭ জন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা গেছে রাজধানী ঢাকায়। ট্রেনে কাটা পড়া ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াকেই এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে পুলিশ। তাদের মতে, শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রেললাইনের দুপাশের অবৈধ দখলের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। এর মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কুড়িল, খিলক্ষেত, মহাখালী, ক্যান্টনমেন্ট, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, গেন্ডারিয়ার মতো জনবহুল এলাকাগুলোর রেললাইনে।খবর প্রথম আলো’র।
ঢাকা থেকে প্রতিদিন ১০৮টি ট্রেন বিভিন্ন রুটে আসা-যাওয়া করে থাকে। ২০১৬ সালে ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকায় ২৯৬ জন ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৫৬ জন। ঢাকা রেলওয়ে থানার তথ্য অনুযায়ী, নিহত ২৫৬ জনের মধ্যে ২০৪ জন পুরুষ, বাকি ৫২ জন নারী। এই ১০ মাসে নিহত ১৪ জনের বয়স ছিল ১ থেকে ১৮ বছর, ১৯৭ জনের বয়স ১৯ থেকে ৫০ বছর ও ৫১ বছরের ঊর্ধ্বে নিহত হয়েছেন ৪৫ জন। পেশাজীবীদের মধ্যে এ সময় ৬৫ জন শ্রমিক মারা গেছেন ট্রেন দুর্ঘটনায়। এরপরই চাকরিজীবী রয়েছেন ৪৯ জন। এ ছাড়া ১০ জন রয়েছেন শিক্ষার্থী। নিহত বাকি ১৩২ জন হলেন অন্যান্য পেশার। আর চলতি বছরের প্রথম মাসেই মারা গেছে ৩১ জন।
ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকার রেললাইনে সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ যায় ২০১৪ সালে। ওই বছর ৩১৮ জন মারা যায়। অন্যান্য বছরের মধ্যে ২০১৫ সালে ২৮৫ জন, ২০১৩ সালে ৩০৫ জন, ২০১২ সালে ৩০৬ জন, ২০১১ সালে ২১৫ জন ও ২০১০ সালে ২০৩ জন মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়।
অসতর্কভাবে চলাচলে মানুষ রেললাইনে প্রাণ হারায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেছন থেকে ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। কানে হেডফোন ব্যবহার করে রেললাইনে হাঁটা, মুঠোফোনে কথা বলা, রেললাইনের ওপর বসা ও চলাচল এবং রেলক্রসিংয়ে দ্রুত পারাপার করতে গিয়ে মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ছে। রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই তিনটি কারণে ২৫৩ জন মারা গেছে। সবচেয়ে বেশি ১৪৭ জন মারা গেছে দ্রুত রেলক্রসিং পার হওয়ার চেষ্টার সময়। ট্রেন লাইনে বসে ও চলাচলে মারা গেছে ৭৪ জন ও ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে কানে হেডফোন দিয়ে রেললাইনে চলতে গিয়ে। অন্য ৩ জন মারা গেছে ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে। রেললাইনে দাঁড়ালে বা বসে থাকলে পেছন থেকে আসা ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায় না।
এ ব্যাপারে রেলপুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও ট্রেন চালক জানান, ইঞ্জিনের এই শব্দ দুপাশে ছড়িয়ে যায়। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময়ই মানুষ রেললাইনের ওপর দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটাচলা করে। অনেকে মুঠোফোনে কথা বলতে থাকে। কেউবা রেললাইনে বসে কথা বলতে থাকে। এ কারণে ট্রেন থেকে হুইসেল বাজালেও সেটি রেললাইনে থাকা মানুষেরা শুনতে পায় না।
আইন না মানায় দুর্ঘটনা : ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলামের ‘রেলওয়ের আইন মানতেই হবে’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করা হয়, ‘রেলওয়ে পরিচালনার জন্য দেশে আছে রেলওয়ে আইন ১৮৯০। এ আইনে রেল চলাচলের জন্য পূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেললাইনের আশপাশে যেন কোনো অবৈধ স্থাপনা না উঠতে পারে, এ জন্য কার্যকর আছে রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। রয়েছে রেল পুলিশ (জিআরপি)।’
রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯ অনুযায়ী রেলওয়ে সম্পত্তিতে কারও বেদখল হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাত বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ আইন অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী এ বিচার চলবে। আবার দেওয়ানি কার্যবিধিও ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগ হবে এবং অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতাও কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেললাইনের দুপাশে ১১ ফুট জায়গা খালি রাখার নিয়ম রয়েছে।’
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক বলেন, ‘আইন না মানায় দুর্ঘটনা ঘটছে। নিয়ম না মেনে চলাচল করায় এই দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতার জন্য রেলস্টেশন ও আশপাশে মাইকিং করে থাকি। লিফলেটও বিতরণ করছি।’
রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ২৫টির মতো রেলক্রসিং রয়েছে। তবে অনেক জায়গায় স্থানীয় এলাকাবাসী নিজেরাই সহজ চলাচলের জন্য রেললাইনের ওপর অর্ধশত ক্রসিং বানিয়েছে। রেলপুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ এই ক্রসিংগুলোও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
রেলক্রসিংগুলো শতভাগ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মাদ মাহবুব আলম তালুকদার। তিনি বলেন, জনসংখ্যা বেশি, যে কারণে ঢাকা ও এর আশপাশে ট্রেন দুর্ঘটনাও বেশি। প্রথমত রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। দুর্ঘটনা কেন ঘটল আজ পর্যন্ত জবাবদিহিও নেই। কাউকে শাস্তি দিতে পারলে হয়তো দুর্ঘটনাও কমত। ঢাকা সিটিতে রেলক্রসিংয়ে অনেক আগে থেকে বার ফেলে দেওয়া হয়। ক্রসিংয়ে যাঁরা গার্ডম্যান তাঁদের অনেকে আবার চা বিক্রি করেন। ফলে অনেক চালক অধৈর্য হয়ে যান, এঁদের মধ্যে অদক্ষ চালকও রয়েছেন। তাই রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা দিতে হবে। লাইনম্যান দিতে যাবে।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, ‘দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। দুর্ঘটনা নানা কারণে ঘটে। দুর্ঘটনা যাতে কমানো যায়, এ জন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। লেভেল ক্রসিংগুলোর মান উন্নয়নে ৬৫০ লেভেল ক্রসিংয়ের মান উন্নয়নে দরপত্র ডাকা হয়েছে। ১৮০০ গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, এসব পদক্ষেপে দুর্ঘটনা কমবে।’
মন্তব্য চালু নেই