‘সহায়ক সরকার’ ঘিরে ফের উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতি

আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ‘সহায়ক সরকার’ ইস্যুতে নতুন করে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। নতুন ইসি গঠনের পরপরই এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে রাজনীতির মাঠ পেরিয়ে অন্দরমহলেও।

চায়ের কাপে কিংবা রঙিন পানির আড্ডায় উঠে আসছে ‘সহায়ক সরকার’ ইস্যুটি। বিষয়টি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরকারের স্বস্তি মনোভাবে কিছুটা হলেও উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে।

যদিও এটি এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে এক ধরনের প্রস্তুতির আভাসও মিলছে দু’দলেই। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে উদ্বেগও।

একদিকে যেমন নিজেদের এই ভাবনা নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি, তেমনি সেই ভাবনাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার কৌশল ফাঁদছে আওয়ামী লীগ।

বিএনপি চাইছে, ইসির ব্যর্থতার পর এই দাবিকে আঁকড়ে ধরেই মাঠে থাকতে ও সফল হতে এবং এর মধ্য দিয়েই পরবর্তী ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতে। আর বিএনপির সেই কৌশলকেই রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে নিয়ে আরেক দফা ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চাইছে আওয়ামী লীগ।

ফলে নির্বাচনকালীন রাজনীতিতে এবার সহায়ক সরকার ব্যবস্থাই মূল ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত এই দাবিকে কেন্দ্র করেই দেশের রাজনীতি না আবার সহিংস হয়ে ওঠে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে নানা মহলে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার চাইছে, বিগত সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মতোই ব্যর্থ করতে বিএনপিকে। আবার এ দাবিতে মাঠেও চাইছে তাদের। কারণ বর্তমানে বিএনপির যে সাংগঠনিক অবস্থা তাতে দাবি আদায়ের মতো পরিস্থিতি দলে নেই। ফলে এ দাবিতে মাঠে রাখতে পারলে সাংগঠনিকভাবে বা নির্বাচনী প্রস্তুতিতে আরো দুর্বল করে ফেলা যাবে ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে।

সেই সুযোগে নির্বাচনের জন্য নিজেদের আরো বেশি শক্তিশালী করতে পারবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলার গতি ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপেও রাখতে চাইছে বিএনপিকে।

এর কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা প্রায় প্রতিদিনই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে এমন সব মন্তব্য করছে, যাতে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল আরো ভেঙে যায়।

শাসক দলের মতে, এ মুহূর্তে বিএনপির সাংগঠনিক ও আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। আছে শুধু জনসমর্থন ও বিপুলসংখ্যক ত্যাগী নেতাকর্মী। দলটি নিয়ে এমন নেতিবাচক মন্তব্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের হতাশা চরমে পৌঁছবে।

এমনকি সহায়ক সরকারের দাবিতে ভবিষ্যতে বিএনপির কট্টর অবস্থান ঠেকাতে বিশেষ কৌশলের কথাও ভেবে রেখেছে আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করলেই আগাম নির্বাচনের কথাও শোনা যাচ্ছে দলের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখেই এক বছর আগেই নির্বাচন দিতে পারে সরকার।

সহায়ক সরকারের ব্যাপারে এক আওয়ামী লীগ নেতা প্রশ্ন করেন, সহায়ক সরকার আবার কি? উদ্ভূত দাবি। সংবিধানের কোথায় এটি আছে? তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই।

সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের যে পদ্ধতি চালু হয়েছে তাই থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীই (শেখ হাসিনা) নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হবেন এবং সেই সরকার নির্ধারিত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সংসদীয় গণতন্ত্রের যে ধারা চালু হয়েছে সেটা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে না।

অন্যদিকে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সদ্য গঠিত ইসিতে আস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই। সিইসি দলীয় অনুগত এবং পরীক্ষিত। তার অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেরই লোক সিইসি।

তিনি বলেন, এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। তবে ইসি যেমনই হোক না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী সহায়ক সরকার গঠন খুবই জরুরি। নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে তাকেও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে হবে।

ফলে দুই দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান শেষ পর্যন্ত না নতুন কোনো সংঘাতের সৃষ্টি করে, এমনটি আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নতুন ইসি গঠনের মধ্য দিয়ে সরকারই সহায়ক সরকারের দাবি সামনে আনার পথ তৈরি করেছে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সংশ্লেষ প্রকাশের পর বিএনপি যে নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের দাবি করে আসছিল, এখন তার যৌক্তিকতা আরো বেড়েছে। সুতরাং, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে সেরকমের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এখন প্রশাসনে যারা রয়েছেন, তারাও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক।

তিনি আরো বলেন, নির্বাচনকালীন প্রশাসনের এসব পদে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের বসাতে হবে। আর প্রশাসন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ একটি সরকারও প্রয়োজন। কারণ নির্বাচনকালীন কমিশনের অধীনে প্রশাসন থাকলেও তাদের কথা শুনবে না। প্রশাসন সরকারের কথাই শুনতে বাধ্য হয়। আর সে ভাবনা থেকেই বিএনপি সহায়ক সরকার ফর্মুলার কথা বলছে।

একই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার চাওয়ার পেছনে মূল কারণটা হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি মনে করছে, বর্তমান ইসি ও রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। তাই তারা এমন ব্যবস্থা চাইছে যার মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।

এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে রাজপথে নেমেছিল বিএনপি। তবে কোনো লাভ হয়নি। নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। তারপর বিএনপি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ থেকে সরে এসে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৯৪ দিন হরতাল-অবরোধ আন্দোলন করে। কিন্তু সে আন্দোলনও নিষ্ফল হয়। গত প্রায় দুই বছর আর রাজপথে বড় আন্দোলনে নামেনি দলটি।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার গুলশানের অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে এই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখার কথা জানান। সেখানে বলা হয়, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’-এর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, হস্তক্ষেপমুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।

এই সহায়ক সরকার হবে তিন মাস মেয়াদের। রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচনকালীন এই সরকারের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্রেট কোটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে। রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত করতে পারেন। এই রূপরেখায় নির্বাচনকালীন তিন মাস প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে থাকার প্রস্তাব থাকছে।



মন্তব্য চালু নেই