সরকার ও জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসার গল্প !

কার না ভাল লাগে কবিতা আর গল্প লিখতে কিংবা! ইচ্ছাই হোক আর অনিচ্ছাই হোক সবাই জীবনের কোন না কোন সময় কবিতা-গল্প লিখেছেন। ফলে বলা যায়- গল্প-কবিতাকে সবাই কমবেশী ভালবাসে।আর যদি হয় সেটা ভালবাসার গল্প, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আমরা সবাই জানি এবং বিশ্বাস করি মানুষকে ভালবাসার চেয়ে বড় কোন ইবাদত আর নেই। সুপ্রিয় পাঠক, তাই আজকে আপনাদের সরকার ও জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসার একটি গল্প শোনাবো কেমন!

হয়তো আমার মতো সবারই স্মরণে আছে ১/১১ সংবিধান বর্হিভূত সরকারের আমলে দেখা যেত বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত সরকার নিতো মধ্যেরাতে। গভীর অন্ধকারে জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে সরকার আদালত বসাতো। শেষ রাতে নেতা-নেত্রীদের বাসা হতে ধরে আনা হত। তারপর মইন – ফকরউদ্দিনের শেখানো বুলি পথে-পান্তরে বসানো ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যেমে চাপিয়ে দেওয়া হত। গভীর রাতে সরব থাকতো সরকার।আর জনগণ গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো।

স্মরণে আছে-বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা এবং পরবর্তীতে মুক্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল রাতের অন্ধকারের সরকারের গোপন বৈঠকে, খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। রাতের অন্ধকারেই বৃদ্ধি করা হতো চাল, ডাল ও তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম। তখন রাত নামলেই নানা গুজবে ভাসতো দেশ। সাংবাদিকরা বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের বাসার সামনে রাত জেগে ঢুলঢুলু চোখে বসে থাকতেন।১/১১এর আগমনে নাকি মিডিয়াই অবদান রেখেছিল! তাই তাদের নাইট ডিউটি দেখে অবাক হইনি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে দেশবাসিকে ঘুমিয়ে রেখে নানান ষড়যন্ত্র যে চলছে তা বুঝতে জনগণের আর বাকি থাকে নাই। ফলাফলে ক্রমেই জন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সরকার। মইন বুঝতে পারে বাংলাদেশিরা অন্ধকার পছন্দ করে না। তাদেরকে বেশিদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব নয়। অনিচ্ছা সত্বেও তাই পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা।

এরপর ক্ষমতায় আসে আওমীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার । তারা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে।নামে মহাজোট বললেও তাদের মন্ত্রীসভা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একলা চল নীতির কারণে জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হতে চলছে সরকার। আওয়ামী সরকার যেন উদ্দিন সরকারের ফেলে যাওয়া জুতো পরেই হাঁটছে। কেননা, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, এই সরকার জনগণের সরকার, তারা জনগণের ভালবাসা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা দেশ ও জনগণকে অধিক ভালবাসে বলে জনগণও তাদেরকে বেশী ভালবাসে। তাইতো জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে যা ইচ্ছে তা সিদ্ধান্ত নিতে কোনো অসুবিধে হয় না। সরকারের অধিক ভালবাসায় জনগণ এখনো ঘুমিয়ে, কিন্তু বাস্তবতা! এতক্ষণ গল্পের প্রেক্ষাপট বললাম, এবার আসি মূল গল্পে কেমন!

এতদিন ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তারা বিনা কারণে অসৎ পন্থায় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা অর্জনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। এজন্য অবশ্য বিগত ১/১১ সরকারের আমলে অনেক ব্যবসায়িকে জেলের ভাতও খেতে হয়েছে। কিন্তু আজ যখন পত্রপত্রিকায় দেখি সরকার নিজেই জনগণকে অন্ধকারে রেখে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্য থেকে মুনাফা অর্জন করছে, আন্তর্জাতিকবাজারে মূল্য হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও দেশীয় বাজারে দাম কমাচ্ছে না। তখন স্বভাবতই সরকারের স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। তাহলে কী সরকার নিজেই শুভঙ্করের ফাকিঁর সাথে জড়িত? এটা কী জনগণের সাথে সরকারের এক ধরনের প্রতারণা নয়?

এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে, জ্বালানি তেল নিয়ে সরকারের মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে। গত কয়েক দিনে পত্রপত্রিকা পাঠে যা জানতে পেলাম তাতে জ্বালানি তেল নিয়ে সরকারের শুভঙ্করের ফাকিঁর বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ যে এক রকম আঁতকে উঠার মতো। কেননা, দেশ স্বাধীনের পর জনগণের সাথে কোনো সরকার এমন প্রতারণা করেছে বলে আমার জানা নেই।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে- বিশ্ববাজারে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে সরকার। এতে সরকারের লাভ হলেও সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো-সরকার যে শুধু গাড়িতে ব্যবহৃত অকটেন বিক্রি করেই মুনাফা করছে তা নয়, গরিব মানুষের জ্বালানি কেরোসিন থেকে শুরু করে ডিজেল বিক্রি করেও বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এখাত থেকে মুনাফা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। যা বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা নিজেও জ্বালানি থেকে সরকারের মুনাফা অর্জনের বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব এবং বিপিসির দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন ও পেট্রলের উৎপাদন ব্যয় পড়ছে ৫৬ টাকা ৮৫ পয়সা। যা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে যথাক্রমে ৯৯ ও ৯৬ টাকায়। এতে বিপণন কোম্পানি ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কমিশন বাদ দিয়ে বিপিসির মুনাফা থাকছে ৩৫ টাকা ৪৯ পয়সা। একইভাবে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের উৎপাদন ব্যয় পড়ছে ৬৮ টাকা, যা গ্রাহকের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে বিপিসি মুনাফা অর্জন করছে যথাক্রমে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা ও ১৩ টাকা ৭৭ পয়সা। তেমনি ডিজেল ফার্নেস তেলের উৎপাদন ব্যয়৬০ টাকা হলেও তা বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করছে ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা এবং প্রতি লিটার জেট ফুয়েলে (বিমানের জ্বালানি) বিপিসির মুনাফা হচ্ছে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা করে।

যতদূর জানা যায় তাতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করে প্রায় বছর খানেক আগে থেকে। এখনো জ্বালানি তেলের দাম কম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেয়া তথ্য মতে, গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকে। ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার থেকে কমে একপর্যায়ে তা ৫৮ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। বর্তমানে এর দাম ৭৫ ডলার।

আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষকদের মতে, তেলের দাম আরো না কমলেও সহসাই বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর অদূর ভবিষ্যতে বাড়লেও তা আর আগের পর্যায়ে উঠবে না। এতে ধারণা করা হচ্ছে, আরও অনেক দিন প্রতি ব্যারেল তেলের দাম সর্বোচ্চ ৭৫-৮০ ডলারের মধ্যেই থাকবে।এতদসত্ত্বেও সরকার দেশে কোনো ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমানো বা সমন্বয় না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।

এ ব্যাপারে বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজার বক্তব্য হলো- ‘যুগ যুগ ধরে বিপিসি যে লোকসান দিয়ে এসেছে, তার ফলে সংস্থার দায়-দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের কাছেই ঋণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে কি না, তা অন্যান্য সময়ের মতোই সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এখন পর্যন্ত বিপিসির কাছে দাম কমানোর কোনো নির্দেশনা নেই।’
এছাড়া মুনাফার বিষয়ে তার বক্তব্য-বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম হলেও স্থিতিশীল নয়। প্রতিটি চালানেই দামের হেরফের হয়। ফলে মুনাফার পরিমাণ দীর্ঘ সময় একই রকম থাকে না। অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ না হওয়া পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। তবে মুনাফা যে হচ্ছে তা তিনি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন।

বিপিসির চেয়ারম্যানের দেয়া এই বক্তব্য থেকে থেকে যা বুঝা গেল তা হলো- বিপিসি এই মুনাফার মাধ্যমে আগের লোকসান পোষানোর একটা চেষ্টা করছে। তবে জনগণকে না জানিয়ে এধরনের মুনাফা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বক্তব্য হলো, ‘এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না যে বিপিসি যুগ যুগ ধরে লোকসান দিয়েছে বলে দাম কমলেও তা বেশি রাখতে হবে। বরং বিপিসির লোকসানের অঙ্ক সরকার বাজেটের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে। তারপর দাম কমিয়ে দিলে সব খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

এছাড়া সরকারের এই অবস্থান সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সরকারের এই অবস্থান সঠিক নয়। বিশ্ববাজারে যেহেতু দাম কমেছে, সেহেতু দেশেও দাম কমানো উচিত। জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল থাকে না বলে তিন মাস পর পর দাম পর্যালোচনা করে বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’

প্রসঙ্গত, এই সরকারের গেল মেয়াদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবহন, বিমান ও নৌযান ভাড়া বৃদ্ধি থেকে শুরু করে কৃষিখাতসহ সর্বত্রই এর প্রভাব পড়ে। এতে জীবনযাত্রার মান বাড়ে কয়েকগুণ। বিশেষ করে মধ্যবৃত্ত শ্রেণী, খেটে খাওয়া মানুষ ও কৃষকরা এর বিরূপ প্রভাবের শিকার।

ইতোপূর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বিশ্বব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সমন্বয় করার জন্য অর্থাৎ দেশীয়বাজারে বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। বক্তব্য-বিবৃতিতে সরব থাকে। কিন্তু গেল এক বছর থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও অজ্ঞাত কারণে এখন তা সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা তথা বক্তব্য-বিবৃতি লক্ষ্য করা যায়নি।তবে যতদূর জানা যায়-তারা বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করার পদ্ধতি প্রবর্তন করার পক্ষে, যেমনটি ভারত করেছে। তাতে বিশ্ববাজারে দাম কমলে আনুপাতিক হারে দেশেও কমবে, বাড়লে দেশেও বাড়বে। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের সভায় স্পষ্ট করেই বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নীতি তিনি অব্যাহত রাখবেন।’ প্রশ্ন জাগে তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমাসত্ত্বেও কেন দেশীয় বাজারে কমানো হচ্ছে না?

আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা হলো- আন্তর্জাতিকবাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে কমানো হয়নি। এতে সাধারণ মানুষও তার সুফল পায় না। কারণ, জ্বালানি তেলের অন্যতম প্রধান ব্যবহারকারী পরিবহন খাত ভাড়া কমায় না। নানা অজুহাতে তারা বাড়তি ভাড়া নেয়। এক্ষেত্রে পরিবহন খাতের মালিকানার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা যুক্ত থাকায় সরকার কখনোই ওই লবির সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাঁরা নানা অজুহাতে ভাড়া কমাতে দেন না। আর কৃষিতে যে ডিজেল ব্যবহৃত হয় তার দামও কমানো হয় না। এটা সত্য যে, ‘ফার্নেস তেলের দাম কমালে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমবে। ফলে বর্তমানে আন্তর্জাতিকবাজারের সাথে তেলের দাম সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দরকার হয় না। আর এর সুবিধা সবাই ভোগ করতে পাবেন।কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটা হচ্ছেনা।

আর এটা না করার পেছনে সরকারের ভেতরেও একটি মহল মনে করে জ্বালানি তেলের দাম কমালে পরিবহন, কৃষি প্রভৃতি খাতে ব্যয় কমানোর সুবিধা সাধারণ মানুষ পাবে না। ফলে এটা করার দরকার নেই। এ প্রসঙ্গে মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বক্তব্য হলো- ‘এটি সুশাসনের (গভর্নেন্স) প্রশ্ন। অর্থনৈতিক বিষয় নয়। সুশাসন তো সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।’ অর্থাৎ তেলের দাম কমালে পরিবহন বাড়া কমাতে না পাড়লে এর দায় কী সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে? এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক কারণ হতে পারে না।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার ৪০ বছরে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৩৬ বার। আর কমেছে মাত্র দুইবার ১৯৯০ সালে শুধু পেট্রলের দাম ১২ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে কমে ৭ টাকা ৫১ পয়সা হয়েছে। ডিজেল কেরোসিনের দাম অপরিবর্তিত (৬ টাকা ৭১ পয়সা) ছিল। এছাড়াও ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ডিজেল ও কেরোসিন লিটার ৪৬ টাকা থেকে কমে ৪৪ টাকা হয়েছিল। ৩৬ দফা দাম বাড়ার মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে ৯ বার। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পায়।

জ্বালানি ও খনিজসম্পাদ বিভাগের অপারেশন-১ শাখায়, অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিন এর মূল্যসংক্রান্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের ৬ মে থেকে চলতি বছরের (২০১৫) মে পর্যন্ত টানা ৪৩ বছর ধরে দফায় দফায় সব সরকারের আমলে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। অর্থাৎ, পেট্রল ১ দশমিক ১৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৯ টাকা। ডিজেল ৬৯ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ টাকা। কেরোসিন ৪৮ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ টাকা। অকটেন (৯২ সালে ১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬ টাকা। গড়ে দাম বেড়েছে কত গুণ তা হিসেব করলেই সহজেই যায় বুঝা।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সময় কেরোসিনের মূল্য ছিল ১৫ টাকা রেখে যায় ৩৩ টাকা, পেট্রোল ছিল ২৩ টাকা রেখে যায় ৫৬ টাকায়। জোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দু’মাসের মাথায় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার বছর ২০০৬ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ধাপে ধাপে মোট নয়বার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তেলের দাম দুই দফা বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৯ টাকা, দ্বিতীয় দফায় ২২ টাকা দাম বৃদ্ধি করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই দফায় প্রতিলিটার অকটেন ৩২ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৯ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০৮ সালের পহেলা জুলাই ২৩ টাকা দাম বৃদ্ধি করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারই দাম কমিয়ে ৭৭ টাকা রেখে যায়।

মহাজোট সরকারের গেল মেয়াদে জ্বালানি তেলের দাম বাড়নো ৫ বার। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারী রাতে সরকারি এক আদেশে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়। এ নিয়ে বর্তমান এবার পেট্রোল ও অকটেন লিটারে ৫ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৭ টাকা দাম বৃদ্ধির ফলে প্রতি লিটার পেট্রোল ৯৬ টাকা, অকটেন ৯৯ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ৬৮ টাকায়।

এদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন গত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে প্রতি লিটার অকটেনের দাম ছিল ৫৮ টাকা, পেট্রলের দাম ছিল ৫৬ টাকা আর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ছিল ৩৩ টাকা। এদিকে ফার্নেস অয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ২০ টাকা। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমান সময়ে প্রতি লিটার অকটেনের দাম বেড়েছে ৪১ টাকা, পেট্রলের দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা আর ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৪০ টাকা। অর্থাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে ১০৬ শতাংশ, পেট্রলের দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ, অকটেনের দাম বেড়েছে ৬৯ শতাংশ আর ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ।

জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধিকে জনগণের প্রতি ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শত্রুতাসুলভ আচরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে তারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, দাম কমানোর বদলে সরকার উল্টো রাতের আঁধারে দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে বিদ্যমান অস্বচ্ছতাকে মদত জোগাতেই সরকার এ গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাকথিত ‘কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র’ অনুমোদন দেয়া এবং সরকারদলীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের আমদানির বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যে অস্বচ্ছতা সম্পর্কিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই অস্বচ্ছতাকে গতিশীল করতে সরকার বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের দুর্ভোগ নানাভাবে বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমা সত্ত্বেও দেশীয় বাজারে না কমানোয় অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশায় মেতেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বারবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এতে কৃষি এবং শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে; একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। এতে সব ধরনের জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়ে তা নয়, বাড়িভাড়াও বাড়ে সেহারে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব।

জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের চাষাবাদের ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়েছে। কৃষকেরা দিশেহারা। বিশেষ করে বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকেরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার কারণে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। এতে উৎপাদন খরচ উঠাতেই কৃষকরা হিমসিম খাচ্ছে। ফলে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো উৎপাদনে সেচে অধিক অর্থ ব্যয় করার পাশাপাশি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের খরচও বেড়ে গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে মূলত মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হয়। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায়ও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

জানি না সবার স্মরণে আছে কিনা- মহাজোট সরকারের গেল মেয়াদের প্রথমদিকের কথা। সেই ২০১০’ শেষার্ধ ও ২০১১ সালের প্রথমদিকের কথা- জ্বালানিসহ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিক এবিএম মূসা (বর্তমানে প্রয়াত) বলেছিলেন- যিনি ক্ষমতায় থেকে গুণিজনদেরকে সম্মান করতে জানে না, দুর্নীতি রোধ করতে পারে না, সন্ত্রাস নির্মূল করতে পারে না, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করতে পারে না, প্রতিহিংসামূলক আচরণ ত্যাগ করতে পারে না, তার ক্ষমতায় থাকার অধিকার এক নেই। এছাড়া তিনি বলেছিলেন-এভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি যদি বিএনপির আমলে হতো, তবে তিনমাসও ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক মুসার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, টিভি চ্যানেলের বরাদ্ধ দিইনি বলে নানা কথা বলেন। উনাকে (এবিএম মূসাকে) মিডিয়া (টিভি চ্যানেল) দিলে টাকা কোথায় পেতেন। তার একদিন আগেই ওনি বলেছিলেন ওনাকে যদি অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাহলে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও এদেশে অর্থ উপদেষ্ঠা পাওয়া যাবে না।

এছাড়াও তখন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভায় বলছিলেন-“বিরোধী দলের লোকজনই খাদ্য দ্রব্য মজুত করে দাম বৃদ্ধি করছে”। যদিও এই অভিযোগে তখন সেই বিরোধী দলের একজনকেও ওই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়নি। আর যদি প্রধামন্ত্রীর অভিযোগ সত্য হলে দেশ চালাচ্ছে কে, সরকারী দল না বিরোধী জোট দল?

সবশেষে, সরকারের প্রতি আহবান রাখবো- অবিলম্বে বিশ্ববাজারের দামের সাথে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলে মূল্য সমন্বয় করুন। এটা জনগণের প্রাপ্ত অধিকার। এটা নৈতিকভাবেও যৌক্তিক। অন্যথা জনগণের ঘুম ভেঙে যেতে পারে, সেই সাথে সরকার ও জনগণের দহরম-মহরম ভালবাসারও বিচ্ছেদ ঘটে যেতে পারে। আর এতে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হবে। এমনটি হলে রাষ্ট্রে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে এক ধরনের স্বস্থি ফিরবে।

 

লেখক:

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
গবেষক ও কলামলেখক । ই-মেইল:[email protected]



মন্তব্য চালু নেই