সম্মেলন নেই আওয়ামীলীগের হেভিওয়েটদের জেলায়

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বে থাকা হেভিওয়েট নেতাদের নিজ জেলায় সাংগঠনিক অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। দলের গঠনতন্ত্রের ৩০ নম্বর ধারার ১ উপ-ধারা অনুযায়ী একটি জেলা কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। মেয়াদ শেষে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি করার কথা। তবে এ নিয়ম কেবল কাগজে-কলমেই আছে বছরের পর বছর। দেড় যুগ ধরে সম্মেলন নেই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুনামগঞ্জেও। ১০ বছর সম্মেলনের উদ্যোগ নেই প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফর উল্লাহর ফরিদপুর এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির চাঁদপুর জেলায়। এমনকি দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জেও ১১ বছর পার করেছে তিন বছরের কমিটি দিয়ে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট নেতাদের পাশাপাশি বাদ যায়নি কেন্দ্রীয় অন্যান্য নেতাদেরও নিজ জেলাও। তিন বছরের কমিটি দিয়ে ১১ বছর চলছে দলের কৃষিবিষয়ক ও সমবায় সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাকের টাঙ্গাইল, ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের নেত্রকোনাও। এমনকি আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও আড়াই বছরেও কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।

সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নিজ জেলার প্রতিই নজর নেই শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতাদের। এমন দলবিমুখ আচরণে হতাশা-ক্ষোভ বাড়ছে তৃণমূলে। সম্মেলন না হওয়ায় নতুন নেতৃত্বও উঠে আসছে না। বাড়ছে দলীয় কোন্দল, সংঘাত আর এমপি-মন্ত্রীর বলয়। প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে দলের ভিতরে অসংখ্য পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। দলীয় কর্মসূচিও তেমন নেই। অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন অনৈতিক কাজে। সব মিলিয়ে প্রাচীনতম এ দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম চরম দুর্বল হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের নেতারা এর পুরো দায় চাপিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের। অভিযোগ, তাদের ব্যর্থতায় সম্মেলনজটে পড়েছে জেলা আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ। এই জেলায় সম্মেলন হয় না ১৯৯৭ সালের পর থেকে। কয়েকদফা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন হয়েছে। ভারে ভারে ভারক্রান্ত জেলা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিশোরগঞ্জ জেলার প্রভাব বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের ২৮ জুন কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হলেও নানা কারণে তা আটকে গেছে।

দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিজ জেলা সুনামগঞ্জে দলীয় কোন্দল থাকায় ১৭ বছর ধরে সম্মেলন হয় না। সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ১৮ মার্চ। ওই সময় আবদুজ জহুরকে সভাপতি ও আইয়ুব বখ্ত জগলুলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। ৫৪ সদস্যের ওই কমিটির ১০ জন বেঁচে নেই। ছয়জন দীর্ঘদিন থেকে প্রবাসে আছেন। কেউ কেউ দল ত্যাগ করেছেন। কয়েকজনকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাকিদের মধ্যে নিষ্ক্রিয় আছেন আরও ১০-১৫ জন। হাতে গোনা কয়েকজনকে দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দেখা যায়। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জগলুলকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন যুগ্ম সম্পাদক নুরুল হুদাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে আবদুজ জহুর মারা যাওয়ার পর সভাপতি মতিউর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে কমিটি গঠনের পর কেন্দ্রীয় নেতা প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই দুই বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে জেলা আওয়ামী লীগ। এই বিভক্তি শহর থেকে উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যন্ত এখনো রয়েছে। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও জেলা নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে সম্ভব হয়নি।

দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য, সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফর উল্লাহ এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুর রহমানের জেলা ফরিদপুর। এ জেলায় সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে ২০০৫ সালে। এর এক বছর পর কাজী জাইনুল আবেদীনকে সভাপতি ও হাসিবুল হাসান লাবলুকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালে মারা যান হাসিবুল হাসান লাবলু। নানা ঝামেলার পর জেলা কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। আর তাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেছেন, কয়েক ভাগে বিভক্ত সাংগঠনিক কার্যক্রম। অনেক নেতা নিষ্ক্রিয়।

দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা গোপালগঞ্জে তিন বছরের কমিটি দিয়ে চলছে ১১ বছর। ২০০৪ সালে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সভাপতি মারা যাওয়ায় বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটির কার্যক্রম চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, কেন্দ্রীয় সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সদস্য সুজিত রায় নন্দী এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের জেলা চাঁদপুর। এ জেলায় সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল।
এ কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা ইতিমধ্যে মারা গেছেন। অনেকে হয়ে পড়েছেন নিষ্ক্রিয়। দীর্ঘ ১০ বছর পরও সম্মেলন না হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের জেলা নেত্রকোনা। ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নীরবতায় সম্মেলন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

একই অবস্থা কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাকের নিজ জেলা টাঙ্গাইলেও। ২০০৪ সালে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও আর নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই