সম্পর্কের মধ্যে কেন হয় ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’?

বন্ধুদের সাথে কোথাও যাওয়ার কথা। অনেক প্ল্যান করলেন, অথচ গেলেন না। আবার কাউকে কথা দিলেন যে আপনি যে করেই হোক কাজটা করে দেবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর করা হলো না। সকলেরই জীবনে এরকম ঘটনা এক আধবার হয়েছে। বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে হয়তো আপনার দেওয়া কথাটা রাখতে পারলেন না। এটা কমিটমেন্ট ফোবিয়া নয়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে কোনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার সময় যদি বারবার দেখা যায় যে সে কথা দিয়েও রাখতে পারছে না, তাহলে সেই মানুষটির কমিটমেন্টের সমস্যা আছে এই ভাবনাটা আসতেই পারে।

কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেদের বাইরে অন্য কোথাও জড়িয়ে যেতে ভয় পান। এখান থেকেই কমিটমেন্ট ফোবিয়ার সূত্রপাত। আমরা ভুলে যাই সম্পর্ক অনেকটা ব্যাটারির মতো, এর মেয়াদ আগে থেকে জানা যায় না। সম্পর্কের মধ্যে থাকতে থাকতেই বোঝা যায় সম্পর্কের পরিণতি কী হতে পারে। কমিট করলেই ঠকতে হবে, এই ভেবে সম্পর্ক গড়তে না চাওয়াটা অমূলক। আবার সম্পর্কে ভাঙন হলেও হতে পারে তখন সেই ভাঙনটা কাম্য, মিউচুয়াল ডিসিশন।

অনেকেই আছেন যারা কাজের জায়গায় নিজেকে কমিট করতে কোনো সমস্যা হয় না বা অন্য কোনো সম্পর্ক গড়তেও তারা স্বচ্ছন্দ। অথচ যখনই প্রেমের সম্পর্ককে পূর্ণতা দেওয়ার কথা হয়, তখন তিনি পিছিয়ে যান। তিনি হয়তো একটা প্রেমের সম্পর্কে আছেন কিন্তু সেই সম্পর্ককে একটা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তার মানে এই নয় যে সম্পর্কের শুরুতেই তার মধ্যে সন্দেহ কাজ করছে বা আগে থেকেই সে ধরে নিচ্ছে যে এই সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু যখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ আসে তখনই মনে ভিড় করছে একরাশ নেতিবাচকতা। মনে হচ্ছে, ‘আমি’ কিছুতেই এই সম্পর্কে স্বচ্ছন্দ হতে পারব না। আর এখান থেকেই সম্পর্কের ভাঙন, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

কেন হয় কমিটমেন্ট ফোবিয়া

কমিটমেন্ট ফোবিয়া একদিনেই তৈরি হয় না। ছোট থেকে বড় হওয়ার সময়ে আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। এই সময়ে যদি ‘ডেভেলপমেন্ট অফ সেলফ’-এর ক্ষেত্রে কোনো গঠনগত সমস্যা থেকে যায়, তাহলে পরবর্তীতে কমিটমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। সব মানুষই কমবেশি আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু যারা প্রবলভাবে ‘নারসিসিস্টিক’, তাদের ক্ষেত্রেই অন্য কারো সঙ্গে নিজেকে ভাগ করে নেয়াটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের সত্তা সম্পর্কে তাদের একটা অহমিকা থাকে। মনের মধ্যে একটা অমূলক ভয়ও কাজ করে যে, নিজেকে অন্য কোথাও নিয়োজিত করে ফেললে নিজের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলব। এই কারণে কোনো সম্পর্কে নিজেকে উজাড় করার ক্ষেত্রে একটা জড়তা কাজ করে। যতক্ষণ কোনো সম্পর্ক তাকে আনন্দ দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সম্পর্ক যদি তার কাছ থেকে কিছু আশা করে তাহলেই সে হাঁপিয়ে ওঠে। কোনো মানুষের ব্যক্তিত্বের গঠনই যদি এরকম হয়, তাহলে যেকোনো ক্ষেত্রেই তার কমিটমেন্টের সমস্যা হবে। আবার প্রেমের সম্পর্ক বা বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করার যে ভয়, তা আসে আরো বড় কমিটমেন্টের জায়গা থেকে।

আমাদের প্রাথমিক কমিটমেন্ট তৈরি হয় পরিবারের সঙ্গেই। যদি সেই কমিটমেন্টের জায়গাটা আমাদের অস্তিত্বের সাথে ব্যাপকভাবে জুড়ে যায়, তাহলে পরিবারের বাইরে কারো সাথে সম্পর্ক গড়াটাই তাত্‍পর্যবিহীন হয়ে যায়। ছোট থেকেই শিশুর মধ্যে যদি পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে অন্য সম্পর্ক নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকে, তাহলে নতুন সম্পর্ক নিয়ে মনে অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আবার ছোটবেলা থেকেই বাচ্চার মধ্যে অপরাবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, অন্য কাউকে ভালোবাসলে পরিবারের প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করা সম্ভব নয়। এতে পরবর্তীকালে নিজের তৈরি করা সম্পর্কে কমিটমেন্ট ফোবিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিবারের কমিটমেন্ট লেভেল বেশি থাকে, তাহলে প্রেমের সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে মনে পাপবোধ কাজ করে।

গভীরভাবে দেখতে গেলে শিশুর প্রাথমিক সম্পর্কবোধ তৈরি হয় মাকে ঘিরে। এটা এমন একটা সম্পর্ক যার মধ্যে ভালোবাসাও আছে, ঘৃণাও আছে আবার নিজেকে উত্‍সর্গ করার প্রবৃত্তিও আছে। সম্পর্কের এই দ্বিমুখিতার কারণে ব্যক্তি সেখানে আটকে যায়। তার ফলে এই আবেগগুলোকে অতিক্রম করে অন্য সম্পর্কে দেয়ার মতো কোনো কিছুই থাকে না। অনেক সময় যে পরিবারে মা-বাবা একসঙ্গে থাকেন না, সে পরিবারের ছেলেমেয়েরা কমিটমেন্টে বাঁধা পড়তে ভয় পায়। মা-বাবার “ল্যাক অফ কমিটমেন্ট”-এর সাক্ষী থাকার ফলে এরা ভাবে যে এদের জীবনে একই অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে রয়েছে। এখানে মা-বাবা একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। যদি যুক্তি দিয়ে বিচ্ছেদের কারণটা বোঝানো যায় তাহলে এমন পরিবারের ছেলেমেয়েরা আবার সম্পর্কে আস্থা খুঁজে পেতে পারে। আবার এমনটাও হতে পারে যে, কোনো গভীর সম্পর্ক ভেঙে গেলে মানুষের মধ্যে এক অস্থিরতা কাজ করে। আর একবার নিজেকে কোথাও সম্পূর্ণভাবে বেঁধে ফেলতে সাহস হয় না। এই অনিরাপত্তাবোধ থেকেই এরা একের পর এক সম্পর্ক গড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু কোথাও আর আটকা পড়তে চায় না।

তথ্যসূত্র: অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়, কনসালটেন্ট সাইকোলজিস্ট, ভারত,
শাহিন সুলতানা, শিশু বর্ধন, পারিবারিক বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক



মন্তব্য চালু নেই