সমাধান কোন পথে?

চলছে অবরোধের ২৪ দিন। মানুষ পুড়ছে যত্রতত্র, হারাচ্ছে নিরীহ প্রাণ, শোকাহত পরিবার হারাচ্ছে আপন জন অথবা পরিবারের উপার্জনক্ষম প্রধানকে। ভেঙে পড়ছে অর্থনীতি। একদিকে বিএনপি চাইছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অপরদিকে সরকার বলছে, সন্ত্রাসী বা নাশকতাকারীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়।নাগরিক সমাজ বরাবরের মতোই সংলাপের পক্ষে। জনসাধারণ চাই শান্তি, জীবনের নিরাপত্তা, দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কোনো বাস্তবমুখী তৎপরতা নেই। সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ। তাই অজানার পথে হাঁটছে দেশ, দেশের গনতন্ত্র ও আপামর জনসাধারণের কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ জীবনের দিশা। কিন্তু সমাধান কোন পথে। বাংলাদেশের সহনশীল জনগণ অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে ঐশ্বরিক কিছু ঘটার প্রতীক্ষায়। কিন্তু বাস্তবে আসলে ঐশ্বরিক বা অলৌকিক কিছু ঘটবে তেমন আশা না করে বিশ্লেষকরা নানানভাবে দিচ্ছেন নানান মত। কিন্তু সকলের নানান মত, নানান পথের দিশা এক পথেই এসে ঠেকছে, সেটি হলো দুই নেত্রীর সমঝোতা বা সংলাপ। কিন্তু দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট।

কেউ কেউ দুই দলের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করলেও সেটি ঠিক বাস্তবমুখি হচ্ছে না। সংলাপ ও সমঝোতার চেষ্টার মতের পক্ষেই পাল্লা ভারী। কিন্তু কীভাবে মিলবে সে পথ তার কোনো হদিস দেখছে না কেউই। বেশির ভাগ মানুষ বলছে, সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। তবে এখন বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যুকে ঘিরে সংকট নিরসনের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। দুই নেত্রীর দেখা হলে বরফ গলার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিয়ে যেমন পরিস্থিতি জটিল করেছে বিএনপি, একইভাবে হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়ার নামে বিভিন্ন স্থানে মামলা করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। দুই দলের বিরোধ আরও উসকে উঠেছে। সমাধানের পথও চলে গেছে দূরে। বর্তমান সংকট উত্তরণের উপায় প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, ‘দেশের এখন যে সংকটময় পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে শুধু দুই নেত্রীই নন, এর বাইরে যারা আছেন তাদের নিয়েও একটি আলোচনা হওয়া দরকার। এক আলোচনাতেই সব সমাধান হয়ে যাবে, আমি তা মনে করি না। এর জন্য সময় লাগবে। সবাই মিলে সময় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ পরিস্থিতির অবসান ঘটানো ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। বিএনপি তা হেলায় ছেড়ে দিয়েছে। তবে আমি এখনো আশাবাদী। সামনে কুলখানি আছে, তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফোন করে তাকে আসতে বলতে পারেন। আর সেটি বিবেচনা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটানোর মতো ইস্যু নিয়ে যদি আলোচনা করার মতো বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে দুই নেত্রী আবার উদ্যোগ নিতে পারেন। শুধু একবার সমবেদনা জানানোর মতো যে বিষয়, সেখান থেকেই সব ঠিক হয়ে যেতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। তিনি বলেন, পরিস্থিতির একটি দিক বিবেচনা করলে রাজনৈতিক অস্থিরতার যেসব উপসর্গ তা নিরসন করতে সরকারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অসুস্থ রাজনীতির কারণেই মূলত আজকের এই সমস্যা। এই অসুস্থ রাজনীতির অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দুই দলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রয়োজন আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচনই দিতে পারে বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান। আর আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও নিরপেক্ষ পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ নিরাপদ নয়। বাসে আগুন, পেট্রলবোমা মারার ঘটনা ঘটছে। গর্ভবতী মহিলা, শিশু, শিক্ষার্থী কেউ এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। একজন নাগরিক ও শিক্ষক হিসেবে আমিও উৎকণ্ঠিত। চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে হওয়া উচিত। রাজনীতিবিদদের এ কথা মনে রাখতে হবে, রাজনীতির কবলে পড়ে যেন কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে না পড়ে। দেশের সাধারণ মানুষ, অর্থনীতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ কথা বিবেচনায় রেখে বড় রাজনৈতিক দুই দলকে দ্রুত সমঝোতায় আসতে হবে। এ জন্য সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।’প্রবীণ রাজনীতিক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সমাধানের উপায় দুটো। এক. দুই দলের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া। এখন দুই নেত্রীর কেউ যদি নমনীয় হন তাহলে তিনিই জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। জনগণের এই পাল্স্ বুঝে নমনীয় হলেই পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব। দুই. বিবদমান দুই পক্ষের মীমাংসা না হলে তৃতীয় একটি জোটের আবির্ভাব হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মতো দলগুলোর কারোরই এককভাবে তৃতীয় পক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় সদ্বুদ্ধির ছোট দলগুলোকে এক হয়ে আবির্ভূত হতে হবে।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদের মতে, দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থান এখন উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে। এ অবস্থায় কোনো সংলাপ হওয়ার নয়। হলেও টেকসই কোনো সমাধান সেখানে আসবে না। আমি পরিস্থিতির উত্তরণে দুটো পথই দেখতে পাই। এক. রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পরিত্যাগ করে সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো মেনে নেওয়া এবং সন্ত্রাস-সহিংসতার পথ ত্যাগ করে পরিচ্ছন্ন গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে আসা। দুই. পঁচাত্তরে যেমন অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকে নির্মূল করা হয়েছিল তেমন করা। এখন সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে। তারা কোন পথে যাবে।

ভিন্নমত প্রকাশ করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, সহিংসতার সমাধান রাজনীতির পথেই সম্ভব। বিশ্বব্যাপী সহিংসতা হলেও সেসব স্থানে সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি ছয়টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিষয়টা যেহেতু রাজনৈতিক, তাই সমাধানের জন্যও রাজনৈতিক পথেই যেতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সহিংসতার সমাধান করতে হলে উভয় পক্ষকে বিপরীতমুখী অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। জনগণের জন্য রাজনীতি করলে তাদের বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টান্ত স্থাপনের সময় এখনই। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপিকেও জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এ ছাড়া বিএনপি সহিংসতার জন্য ভুল স্বীকার করতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাকে বলব ‘একটি কঠিন রোগ’। তবে এটি ঠিক যে চিকিৎসায় রোগ ভালো হয়। রাজনীতির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এ মুহূর্তে দরকার সংলাপ। প্রথমত ‘সংলাপ’, দ্বিতীয়ত ‘সংলাপ’ এবং তৃতীয়ত ‘সংলাপ’। আলোচনা ছাড়া আজকের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কোনো উপায় নেই। যদিও সে আশা এখনো দূর-আশাই মনে হচ্ছে।”স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘চারদিকে শুধু অন্ধকার, ভয়ঙ্কর অন্ধকার। সমাধানের কিছুই দেখছি না। দুই দলই অনড়। যেহেতু এটি রাজনৈতিক সমস্যা, তাই রাজনৈতিকভাবেই এটি সমাধান করা উচিত। এ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত কোনো সমাধান হবে না। সেটি হতে পারে সংলাপের মাধ্যমে মধ্যবর্তী নির্বাচন বা অন্য কিছু। জনগণের কাছে এত সব বোধগম্য নয়। তাদের স্বার্থে যে কোনোভাবেই হোক সবাইকে ছাড় দিয়ে সমাধানে আসতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, ‘দেশের অচলাবস্থা নিরসনে একটি সুযোগের ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রটি বিএনপি নষ্ট করেছে। এটি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ের জন্যই সুযোগ ছিল। সুযোগ ছিল দেশবাসীর স্বার্থে। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রধানমন্ত্রী যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, এমন উদারতা আবারও তিনি দেখাবেন। চলমান সহিংতা নিরসনে অতীতের মতো আবারও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে বসবেন।’ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, ‘আলোচনা ছাড়া সমাধানের কোনো পথ দেখছি না। শক্তি প্রয়োগ করে সহিংসতা বন্ধ হবে না। সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে দমন করতে বিএনপির সহায়তা দরকার।’ দেশের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না দাবি করে এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। সবাই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলছে। এই সংকট উত্তরণে মতানৈক্য দূর করে সমাধানের তাগিদ দেন ব্যবসায়ী এ কে আজাদ।



মন্তব্য চালু নেই