খালেদা নয়, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ঘুমিয়ে!

সমঝোতার পথ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা

দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) মধ্যকার সাক্ষাৎ যখন অধরা, ঠিক তখন একটি শোকই দুইজনকে কাছাকাছি নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু সন্তানহারা মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখায়’ তা আর সম্ভব হয়নি।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সমাবেদনা জানানো তো দূরের কথা তার গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশও করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কার্যালয়ের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে গণভবনের উদ্দেশে ফিরে যান তিনি।

দেশের এমন বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার ‘ঘুমিয়ে যাওয়ার’ কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়াকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে বিএনপির এমন সিদ্ধান্ত বৈরীপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমঝোতার পথকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।

আরাফাত রহমানের মৃত্যুর খবরে বেগম খালেদা জিয়াকে সমাবেদনা জানাতে রাত সাড়ে ৮টায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের সামনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে রওয়ানা হওয়া মাত্রই খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুত্রের মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসনের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় তাকে (খালেদা জিয়া) ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এ মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যেন এখন এখানে না আসেন।’

শিমুল বিশ্বাসের এমন প্রেস ব্রিফিংয়ের কয়েক মিনিট পরই প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে উপস্থিত হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা। এ সময় কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে থাকলেও কার্যালয়ের ভেতর থেকে প্রধান ফটকটি বন্ধ করে রাখা হয়। তখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতা কিংবা খালেদা জিয়ার পরিবারের কোনো সদস্যও প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী আবার গণভবনের উদ্দেশে রওয়ানা হন।

তখন উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোহবান চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসনকে সমবেদনা জানাতে আসায় কোনো রাজনীতি ছিল না। বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ মানবিক। প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন একজন নেত্রী হিসেবে, একজন মা হিসেবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ফিরে যাওয়া কোনো রাজনৈতিক শিষ্টাচার নয়, ভদ্রোচিত আচরণও নয়।’

পরে আবার খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও খালেদা জিয়ার দেখা করা নিয়ে যেন নোংরা রাজনীতি না হয়। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব সাইফুজ্জামান শিখরের সঙ্গে আমি রাত ৭টা ১০ মিনিটে কথা বলি। তাকে বলি যে, বিএনপি চেয়ারপারসন অসুস্থ, তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তার পরও প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ।’

শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী অসুস্থ থাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। এরপর তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যখনই আসবেন, তখনই বিএনপির চেয়ারপারসন তার সঙ্গে দেখা করবেন। এটা নিয়ে যেন নোংরা রাজনীতি না হয়।’

বিএনপির চেয়ারপারসনকে সমাবেদনা জানাতে আসলে প্রধানমন্ত্রীকে দেখা করতে না দেওয়াকে দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির জন্য আরেকটি নেতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। সমবেদনা জানাতে দিলেই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলেও একটি ইতিবাচক সমঝোতা তৈরীর পথ সুগম হতো বলে মনে করছেন তারা।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের মৃত্যু যে কতটা কষ্টের হতে পারে তা কেবল সেই মাই বলতে পারবেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই পুত্র ছোট বেলায় তাদের বাবাকে হারিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া মা হয়ে দুই সন্তানের প্রতি বাবার আদর ভালোবাসাও দিয়েছেন। তাছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে দুই সন্তানই তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এরই মধ্যে এক সন্তানের মৃত্যু। যা কখনোই কোনো মায়ের কাছে স্বাভাবিক নয়। তাদের মানসিক কিংবা শারীরিক অবস্থা অবশ্যই ভেঙে পড়বে। এ মুহূর্তে তার পক্ষে কারো সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা দেখা করাটাও কতটুকু সম্ভব আমি জানি না।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতা বা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, শেখ হাসিনাও মানবিক দিক বিবেচনা করেই শোকাহত মায়ের পাশে এসেছিলেন সমবেদনা জানাতে। কিন্তু যেভাবে তাকে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তা কখনোই কাম্য নয়। এটা একটি শোকময় পরিবেশের মধ্যে নোংরা রাজনীতির মিশ্রন ঘটিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের দেশের দিকে তাকায়, তাহলে দেখব একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে আরেকজন প্রতিবেশীর ঝগড়া থাকলেও কারো মৃত্যুতে কেউ বসে থাকে না। কিংবা একজন আরেকজনকে সমবেদনা জানাতে আসলে বাধাও দেন না। হয়তো বা খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করানো সম্ভব ছিল না। তাই বলে কি এমন কেউ ছিল না যে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাবে। নিকট আত্মীয়রা তো পারতেন প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে নিয়ে যেতে। এখন বিএনপির দিক থেকে যত কথায় বলা হোক না কেনো, জানি না তারা কি বুঝে এটা করেছেন, প্রকৃত পক্ষে এমন কর্মকাণ্ড দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিরতা আরও উস্কে দিতে পারে।’

সাখাওয়াত হোসনে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যদি খালেদা জিয়ার দেখা হতো তাহলে হয়তো সেখানে কোনো রাজনৈতিক আলাপ হতো বলে আমি মনে করি না। আবার আজকের দেখা হওয়ার মধ্য দিয়েও যে সকল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতো তাও মনে করি না। কিন্তু এ দেখা হওয়ার মধ্যে দিয়ে দুই নেত্রীর মধ্যকার অনড় অবস্থানের কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। এটা হতে পারতো পরবর্তী সংলাপের বা সমঝোতার প্রথম ধাপ।’

একই বিষয়ে কথা বলা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি নোংরা উদাহরন সৃষ্টি করল। একটি পারিবারিক ও মানবিক বিষয়টিকে বিএনপির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করল। প্রধানমন্ত্রীতো খালেদা জিয়ার প্রতি একজন ব্যক্তি হিসেবে সমবেদনা প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তো তিনি কোনো শর্ত জুড়ে দেননি। হতে পারে কারো সঙ্গে খালেদা জিয়া দেখা করার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না, না থাকাটায় স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীকে কেনো কোনো শত্রুকেও তো আপনি এমন শোকের দিনে গেট থেকে বিদায় জানাতে পারেন না। বিএনপির কোন পর্যায় থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আমি জানি না। তবে বিএনপির এমন সিদ্ধান্ত চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে প্রশমন তো করবেই না, বরং উস্কে দিতে পারে।’

সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রীর গুলশান যাওয়ার মধ্যে আমি কোনো রাজনীতি দেখছি না। কিন্তু বিএনপির নেতারা এখানে কী রাজনীতি দেখল আমি জানি না। তারা কেনো প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দিলেন না, আর এই না দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা কী বলতে চান বা কী প্রমাণ করতে চান তা তারাই ভালো জানেন। তবে তাদের এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক, ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচারণের বহির্প্রকাশ। হয়তো বেগম জিয়া দেখা করার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরেও প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী তো একটু ঘুমন্ত খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন।’

রেজাউল করিম বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেখা করলেই যে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম সব শেষ হয়ে যেতো তেমনটি নয়। বরং এ দেখা হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই নেত্রীর কাছাকাছি যাওয়া শুরু হতো এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে একটি সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত হতো।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু বিএনপি সে সুযোগটা গ্রহণ না করে বরং প্রধানমন্ত্রীকে এক প্রকার অপমাণ করে রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও দীর্ঘায়িত করল। যত দ্রুত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হতো তা আরও মন্থর হলো। খালেদা জিয়া ঘুমিয়ে আছেন এমন কারণ দেখিয়ে রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো।’

এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম বলেন, ‘সব বিষয় নিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে এমন একটি শোকার্ত বিষয় নিয়ে কেউ না কেউ নোংরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। সেটা সরকারের পক্ষ থেকেও করা হতে পারে। কারণ আমি ও আমার স্ত্রী আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর পেয়ে দুপুরেই গুলশান কার্যালয়ে যাই। কিন্তু ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাইনি। কারণ তখন তিনি শোকে এতোটাই বিহ্বল ছিলেন যে কিছু নিকট আত্মীয় ছাড়া কেউ তার কাছে যেতে পারেননি। এরপর আমি সেখানে থাকা অবস্থাতেই ম্যাডামের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আসেন। ম্যাডামের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হবে তখনই আমি জানতে পারি। পরে জানতে পারি প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ে আসবেন ম্যাডামকে সমবেদনা জানাতে। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে শিমুল বিশ্বাসের সরাসরি কথা হয়। শিমুল বিশ্বাস আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর এপিএসকে জানানো হয়েছে এ মুহূর্তে যেন তারা (প্রধানমন্ত্রী) না আসেন।’

রুহুল আলম বলেন, ‘তাহলে আমার প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর এপিএসকে আগে থেকে জানানোর পরও তারা কেনো আসলেন। আসলে রাজনৈতিক নোংরা খেলাটা কি তারা বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই