সন্দেহ যখন সত্যি হয়

সন্দেহবাতিক কি কোনো রোগ? হ্যাঁ, রোগ। মানসিক রোগ। এটা কি কমবেশি সব মানুষের মধ্যেই থাকে? চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, সে রকম আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে কোনো সম্পর্কের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু—এসবই বিশ্বাসের সম্পর্ক। আর অন্য সম্পর্কগুলো—মা-বাবা সন্তান, ভাইবোন রক্তের বন্ধনে অবিচ্ছেদ্য। এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে পারে। চিড় ধরতে পারে। কিন্তু ছিন্ন হবার নয়।

কোনো ঘটনা যদি আপনার মনটাকে বিচলিত করে, মনে প্রশ্ন জাগায়, ‘ও আমাকে ভালোবাসে তো?’ সেদিন হাসপাতালে ২৫/২৬ বছর বয়সী এক মেয়ে এলেন। সঙ্গে মা ও স্বামী। মেয়ের মা কোনো ভণিতা ছাড়াই মেয়ের পরকীয়া নিয়ে সব ঘটনা সবিস্তারে বলে গেলেন জামাইয়ের সামনেই। মেয়ে জামাই চাকরির প্রয়োজনে ঢাকার অদূরে থাকেন। মেয়ে পড়াশোনার অজুহাতে বাবার বাড়িতে। স্বামী ছুটি-ছাটায় আসেন কিন্তু স্ত্রী যেতে চান না। ফোনেও তেমন একটা যোগাযোগ রাখেন না। স্বামীর সন্দেহ ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। মেয়ের চালচলন নিয়ে তাঁর মায়েরও নানা অভিযোগ। কন্যার পরকীয়া সম্পর্ক ভালো ঠেকছে না তাঁর কাছেও। এই প্রেমিক যখন মুখ ফিরিয়ে নিল, মেয়েটি তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। স্বামীবেচারা সব শুনে থ। সব জেনেও স্বামী চাইছিলেন, স্ত্রী তাঁর কাছে থাকুক। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

এর উল্টো চিত্রও আছে। লোকটা ঢাকায় একাধিক দোকানের মালিক। ৩৩ বছরের ধরে স্বাভাবিক সংসার। দুটি মেয়ে। একটি মেয়ে চিকিৎসক। মেয়ের বিয়ের আগে আগে জানা গেল, তাঁর আরেক স্ত্রী রয়েছে। খোদ এই নগরেই আরেক তরুণীকে বিয়ে করে আট বছর ধরে সংসার করছেন প্রথম স্ত্রীর অজান্তে। মেয়ের বিয়ের সময় এমন অভাবনীয় খবরটি সহ্য করতে পারলেন না প্রথম স্ত্রী। হারিয়ে ফেললেন মানসিক ভারসাম্য। কন্যারা বাবাকে সন্দেহ করত। কিন্তু সাহস করে কিছু কখনো বলেনি। সন্দেহ যখন সত্য হলো, ছোট কন্যাও বড় চুপচাপ হয়ে পড়ল।

তরুণদের প্রেমের সম্পর্ক, নবদম্পতির মাঝে সন্দেহবাতিকও কম নয়। মধ্যরাতে প্রেমিকা কার সঙ্গে যেন কথা বলে। যখনই ফোন করে—ফোন বিজি। মোবাইল ফোনে সারাক্ষণ কথা বলা এখন অনেকের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে যে কার সঙ্গে কথা বলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন বলে—তা নিয়ে সংসার-রঙ্গ কম নয়। সিগারেট দিয়ে যেমন নেশার জগতে বিচরণ শুরু হয়, তেমনি ফোন দিয়ে নতুন নতুন সম্পর্কের সূচনা। এটা চিকিৎসক হিসেবে নানা রোগীর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকও পিছিয়ে নেই। কত বছরের সংসার। একজন স্ত্রী বলছিলেন, ‘ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। নিজেরা এখন নিজেদের সময় দেব। ঘুরে বেড়াব। যখন দেখি আমার স্বামী শতব্যস্ততার মাঝেও কার সঙ্গে যেন বাথরুমে বসে কথা বলে। বাথরুম কি কথা বলার জায়গা? সেদিন ফোনে একটা বার্তা দেখলাম। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। কতগুলো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ফেললাম।’

সম্পর্কে সন্দেহ কখন দেয় উঁকি
পরিবেশ, ব্যক্তিত্ব, মনোজটিলতা—সবকিছুই মানুষের জীবনে চলার পথে প্রভাব ফেলে। পুরুষ ও নারীদের মনোকাঠামো জন্মগতভাবেই আলাদা। পুরুষদের প্রকৃতি বহির্মুখী। একই সঙ্গে কয়েকজন স্ত্রীকেও কোনো কোনো সমাজ গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছে। গোপন সঙ্গিনী গোপন রাখা গেলে তাও সই। মেয়েদের বলা হয় ঘরের লক্ষ্মী। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। ঘরের লক্ষ্মী বলতে যদি ধরা হয় ঘরবন্দী, মহলবন্দী মহিলা; সেই যুগ আর নেই। সময় পাল্টাচ্ছে। নারীও সমান তালে এগোচ্ছে। সমাজের এই যে পরিবর্তন, তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে সংশয়-সন্দেহের বীজ মনকে ভারাক্রান্ত করতে পারে, সে আশঙ্কা থাকছেই।

সন্দেহ যখন বাড়ে
আচার-আচরণ বদলে যাওয়া, অতিরিক্ত টাকা খরচ করা, নিয়মিত কার্যক্রমের পরিবর্তন যেমন অফিস থেকে নিয়মিত দেরি করে বাড়ি ফেরা। এর জন্য কিছু অযৌক্তিক যুক্তি দাঁড় করানো, যখন-তখন ঝগড়া করা, মেজাজ দেখানো ইত্যাদি। সংসারে এসব আচরণ বিব্রত করে সঙ্গীকে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিজেকে। এটা সত্য, মানুষের সহজাত ব্যাপারগুলো থাকবে। দৈনন্দিন মানসিক চাপ, অস্থিরতা, টেনশন থাকবেই। রাগ, অভিমান, ভুল-বোঝাবুঝি, রাগ-অনুরাগ—সবই জীবন চলার অনুষঙ্গ। কিন্তু লোক দেখানো আদিখ্যেতা সব সময়ই সন্দেহের জন্ম দেয়। বাড়াবাড়ি আচরণ অনেক সময় ইঙ্গিত দেয়, ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়’।

দূরত্ব বাড়ার নেপথ্যে
কাজের কারণে ঘরের বাইরে বেশি সময় দেওয়া হয়। বাচ্চাদের স্কুল-কোচিংয়ে আনা-নেওয়া, বাজার করা, সংসারে অন্যান্য দায়দায়িত্ব পালন করা। ফলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যথেষ্ট কাছে পান না। ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’—তৃতীয় পক্ষ নাক গলানোর সুযোগ পায়। যখন সন্দেহের তীব্রতা বেড়ে যায়, সন্দেহ আর সন্দেহ থাকে না। আশঙ্কা দেখা দেয় বিবাদের, বিভাজনের।

ভুলের মাশুল কত দিন গুনবেন
মানুষই তো ভুল করে। ভুল করে শেখে। সঙ্গী যদি ভুল বুঝে নিজ থেকে ফিরে আসতে চায়, তখন আপনি কী করবেন? ফিরিয়ে দেবেন? নাকি মেনে নেবেন। পরবর্তী ভুলের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন। সারাক্ষণ টেনশনে থাকবেন আবার কখন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। চোখে চোখে রাখবেন। এটা অসম্ভব।
বিশ্বাস যদি ভঙ্গুরও হয়; তার পরও সন্তানের খাতিরে, সমাজের খাতিরে একই ছাদের নিচে সহাবস্থান করতে হয় বৈকি। কিন্তু যদি মনে করেন, না, সম্ভব নয়। এভাবে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন, তবে যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথেষ্ট সময় নিন। সময়ের হাওয়ায় মনের অলিগলি দেখে নিন। নিজেদের বোঝার সময় দিন। জড়তা, বরফের কঠিন শীতলতা হয়তোবা গলে যেতে পারে।

সঙ্গী সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হলে কী করবেন
সন্দেহ এক ভুলভুলাইয়া। এই বেড়াজাল থেকে বেরোতে উদ্যোগ নিতে হবে দুই পক্ষকেই। আপনি যদি অকারণ বাতিকেরও শিকার হন—বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলবেন না। সঙ্গী কেন সন্দেহ করছে, সেটা চিহ্নিত করুন। সে ক্ষেত্রে আদৌ আপনার কোনো ইন্ধন বা দোষ আছে কি না, যাচাই করুন। সে রকম হলে নিজেকে সংশোধন করুন। সংশোধন, ভুল-ত্রুটি স্বীকার লজ্জার বিষয় নয়। আলাপ-আলোচনা করে সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব। আর যদি অকারণ সন্দেহের শিকার হন, সঙ্গীকে সেটা পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে বুঝিয়ে বলুন। মানুষ যুক্তিশীল প্রাণী। জীবনের চলার পথে অনেক সময় আবেগ হয়তো যুক্তিকে পরাস্ত করে। সেটা সাময়িক। যেটা সত্য ও সঠিক, সেটা ধৈর্য নিয়ে বুঝিয়ে বলুন। ঠকবেন না।

সন্দেহ যখন আপনার মনে
সংশয়, সন্দেহ বাসা বাঁধতে পারে আপনার মনেও। সঙ্গীর কোনো আচরণ, হঠাৎ বদলে যাওয়া, কিছু লুকোছাপার চেষ্টা আপনাকে সন্দেহকাতর করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা রয়েছে। হতে পারে সন্দেহ সত্য। আবার হতে পারে তা অমূলক। তাই কোনো কিছু নিশ্চিত না হয়ে মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলবেন না। চাপ নেবেন না। সময় নিন। সঙ্গী যে সন্দেহজনক আচরণ করছে, সেটা ধৈর্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন। সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তাড়াহুড়া, বিবাদ, খুনসুটির কী দরকার। যদি তা সত্য না হয়, অমূলক সেই ভুলের কথা স্বীকার করুন। কেন সন্দেহ করেছেন, খোলামেলা তা আলোচনা করুন। হতে পারে আপনার সন্দেহবাতিকতায় সঙ্গীও ছিলেন বিপর্যস্ত। সন্দেহ ভঞ্জন হলে তিনিও ভারমুক্ত হবেন। পরে তিনিও সতর্ক থাকবেন। নিজের অসংগত আচরণগুলো তিনিও শুধরাতে চাইবেন।

সন্দেহ যখন বাস্তব
আপনার সন্দেহ যদি যুক্তি ও তথ্যের যাচাইয়ে সত্য হয়, সে ক্ষেত্রেও ধৈর্য হারাবেন না। নিজেকে সংযত রাখুন। তার সঙ্গে বসুন। যেসব আপত্তিকর আচরণ আপনার পছন্দ নয়; কাঙ্ক্ষিত নয়—তা খুলে বলুন। আপনার অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরুন। প্রয়োজনে একান্ত বিশ্বস্তজনের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিন। এমন কারও সহযোগিতা নেবেন, যিনি দুজনের কাছেই গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত। কেবল আপনারই পক্ষ নেবেন, ঘটনার ঘনঘটায় কিংবা উত্তেজনায় তেমন কাউকে বেছে নেবেন না। সমস্যার সমাধান দুটি পক্ষের জন্যই দরকার এবং মঙ্গলজনক। উত্তেজনা, রাগ, বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেবেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মন বিষিয়ে উঠতেই পারে। অসহ্য লাগতে পারে সবকিছু। ইচ্ছে হতে পারে সব ওলটপালট করে দিতে। না, বিরাগের বাড়াবাড়ি, বিদ্বেষ মনোভাব—কোনো কিছুর সমাধান নয়; বরং তা সমস্যাকে আরও জটিল ও তিক্ত করতে পারে। মনে রাখবেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন কাউকে ঘটনা প্রক্রিয়ায় জড়াবেন না, যিনি সমাধানমুখী নন। সঙ্গীকে তার ভুল শোধরাতে সময় দিতে পারেন। সঙ্গী যদি ভুল শোধরাতে আন্তরিক, সেটা অবশ্যই সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করুন। একটি সম্পর্ক মহামূল্যবান। এটা তৈরিতে বছরের পর বছরের অনুরাগ, প্রীতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা কাজ করে। সম্পর্ককে মজবুত করে। কিন্তু অতি উত্তেজনা, রাগ, বিদ্বেষ সেই সম্পর্ককে খুব কম সময়ের মধ্যেই নস্যাৎ করতে পারে। গড়া কঠিন। ভাঙা সহজ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।



মন্তব্য চালু নেই