সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই: বাংলাদেশের পাশে থাকবেন আসেম নেতারা
সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি দুই মহাদেশের জনগণের স্বার্থে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আসেম নেতাদের অঙ্গীকারের মধ্যদিয়ে শনিবার এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলন (আসেম) শেষ হয়েছে।
‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে বাস্তব ফলাফল পেতে উদ্যোগসমূহের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে, সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থা দমন, সমুদ্রসীমা সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, জলদস্যুতা ও সমুদ্রে সশস্ত্র ডাকাতির পাশাপাশি মানবপাচার ও মাদক চোরাচালান, সাইবার নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধের মতো বিষয়ে অভিন্ন স্বার্থের প্রতি আসেম গুরুত্ব দেবে।’
সম্মেলনের শেষ দিনে গৃহীত ঘোষণাপত্রে আসেম নেতারা একথা বলেন।
শনিবার সকালে উলানবাটোরে সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে আসেম সদস্যভুক্ত দেশের নেতাদের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অ্যান্ড ইউরোপিয়ান কমিশন এবং এএসইএএন সেক্রেটারিয়েট প্রধানগণ এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেন। আসেম অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অধিবেশনে যোগ দেন।
আসেম সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা ঘোষণাপত্রে নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং আরো যোগাযোগ, পারস্পরিক স্বার্থে অংশীদারিত্ব এবং এশিয়া ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের একত্রে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
তারা টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তা এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, জাতিসংঘ সনদের নীতি অনুসরণ, আইনের শাসন, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার দুর্নীতি, অভিবাসন, ২০৩০ সাল নাগাদ এজেন্ডা বাস্তবায়নের গুরুত্ব দেবেন বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
পাশাপাশি তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা, খাদ্য, পানি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা, স্থল ও সমুদ্র সম্পদ এবং অবৈধ, অনির্দেশিত ও অননুমোদিত মাছ শিকার, শিক্ষা, দারিদ্র দূরীকরণ, ব্লু ইকোনমি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উদারিকরণ এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদান; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনা, পরিবহন, এমএসএমইস সহযোগিতা, সকল খাতে সক্ষমতা অর্জন, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, যুব এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি ভবিষ্যতে আরো গুরুত্ব দেওয়া হবে।
যেসব বিষয়ে আসেম’র যথাযথ মূল্য সংযোজনের সুযোগ থাকবে তা সম্পন্ন সম্পাদন করার মাধ্যমে এর লভ্যাংশ দুটি অঞ্চলের জনগণের কাছেই পৌঁছানোর ওপর নেতারা গুরুত্বারোপ করেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের অভিমত হচ্ছে- সকল প্রকার সহযোগিতামূলক উদ্যোগ এবং পদ্ধতি জনগণের অংশগ্রহণকে উদ্বুদ্ধকরণমূলক হতে হবে। বিশেষ করে আসেম কর্মকাণ্ড হতে হবে যুব সম্প্রদায় এবং ব্যবসায়ীদের জন্য।
ঘোষণায় বলা হয়, উদ্যোগ এবং প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রটি প্রকৃত সহযোগিতামূলক হতে হবে।
একইসাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমম্বয়ের মাধ্যমে আসেম’র উন্নয়ন শূন্যতা পূরণ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঘোষণায়, আসেম নেতারা বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখী ও সমৃদ্ধশালী শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সুন্দর আগামী গড়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
আসেম’র ২০তম বর্ষপূর্তির এবারের সম্মেলনে নেতারা ২০০৬ সালে আসেম’র ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রদত্ত ’হেলসিংকি’ ঘোষণার কথা স্মরণ করেন। সে সময় আসেম’র অভ্যন্তরে অনানুষ্ঠানিকতা, নেটওয়ার্কিং এবং সাবলিলতাকে উৎসাহিত করা হয়। এর মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একে অন্যের মধ্যে গভীর সামঞ্জস্য সৃষ্টি এবং পরস্পরিক ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আকাঙ্খার যোগসূত্র ঘটানোর উদ্যোগ গৃহীত হয়।
ঘোষণায় নেতারা আসেমকে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যালোচনার মাধ্যমে আসেমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যোগাযোগের সম্প্রসারণ এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন।
এ প্রসঙ্গে নেতারা আসেমকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঅংশীদারিত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং পারস্পরিক মুনাফার দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতি তাদের প্রচেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন।
আসেম’র তৃতীয় দশকে সফলভাবে পদার্পণ করায় একে সফলভাবে পরিচালনার জন্য শক্তিশালী সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে নেতারা ‘এশিয়া ইউরোপ কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক (এইসিএফ) ২০০০ এবং অন্যান্য আসেম ডকুমেন্ট অনুযায়ী অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংলাপ এবং সমবায় উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতি এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বৈশ্বিক রাজনীতি অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীলতার পথে ধাবিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ঘোষণায় বলা হয়, আসেম তার ভূমিকাকে বাহন হিসেবে বহুমাত্রিকতা এবং আইনের শাসন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিশ্ব ব্যবস্থার পথে ধাবিত করবে।
পাশাপাশি সম-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জনগণের শান্তি এবং স্থীতিশীলতার অন্বেষণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং একটি মানসম্পন্ন জীবনের তাগিদে আসেম এর মূল তিন স্তম্ভের সম্প্রসারণ ঘটাবে।
আসেম এশিয়া-ইউরোপের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালীকরণ, বহুমাত্রিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলতেও প্রচেষ্টা চালাবে।
আসেম’র সকল সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখায় মুখ্য হতে হবে যোগাযোগ।
দুটি অঞ্চলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আন্তঃনির্ভরতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আসেমের যেকোন কর্মকাণ্ডে এশিয়া ও ইউরোপকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা যাবে না।
সম্মেলনে নেতারা আসেমের গুরুত্ব ও অস্তিত্ব তুলে ধরতে একটি আসেম দিবস নির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং প্রতি বছর ১ মার্চ বা মার্চের প্রথম সপ্তাহের যে কোনো দিন এটা উদযাপনের সুপারিশ করেছেন।
আসেম নেতারা বলেন, গত ২০ বছরে আসেমের অংশীদারের সংখ্যা ২৬ থেকে ৫৩’তে উন্নীত হয়েছে যা তাদেরকে অনুপ্রাণীত করেছে এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংলাপ ও সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য প্লাটফর্ম হিসেবে এর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণিত হয়েছে।
ঘোষণায় তারা বলেন, টেকসই শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক অবস্থান ঠিক করতে আসেম অব্যাহতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হবে।
আসেম নেতারা আরো বলেন, এশিয়া-ইউরোপ সহযোগিতা রূপরেখা (এইসিএফ)-২০০০ ও অন্যান্য আসেম নথি অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ ও সহযোগিতার উদ্যোগ অব্যাহতভাবে তাদের অংশীদারিত্বের মূলভিত্তি হবে।
তারা বলেন, ভূ-রাজনীতির পালাবদল বিশ্বে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও গোলযোগের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে কার্যকর বহুপক্ষীয় সমন্বয় সাধন ও একটি নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার অনুঘটক হিসেবে আসেমের ভূমিকা আরো বাড়াতে হবে।
নেতারা বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন ও একটি উন্নত জীবনযাপনের যে চাহিদা আমাদের জনগণের রয়েছে তা পূরণে আসেম ভারসাম্যপূর্ণভাবে অংশীদারিত্বের তিনটি প্রধান স্তম্ভ সংহত করবে।
তারা বলেন, এশিয়া-ইউরোপ বহুমাত্রিক ও জনকেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব আরো জোরদার করতে আসেম চেষ্টা করবে।
আসেম নেতারা আসেমের বেশকিছু অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বৃহত্তর সমঝোতায় উৎসাহদান, রাজনৈতিক সংলাপ বিস্তৃতকরণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ত্বরান্বিতকরণ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি এবং এশিয়া-ইউরোপ আন্তঃযোগাযোগ গভীর করা, পারস্পরিক স্বার্থ ও সংযোগ শানিত করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বহুস্তর বিশিষ্ট সহযোগিতা।
তারা আরো বলেন, এই গ্রুপটি জনগণ থেকে জনগণ পর্যায়ে বৃহত্তর যোগাযোগ, আন্তঃআঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং কার্যকর বহুপাক্ষিকতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও অন্যান্য বহুমুখী প্রক্রিয়া জোরদারের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
‘২০ ইয়ারস অব আসেম : পার্টনারশিপ ফর ই-ফিউচার থ্রো কানেকটিভিটি’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে শাংরি-লা হোটেলে দুই দিনব্যাপী ১১তম এশিয়া-ইউরোপ শীর্ষ সম্মেলন (আসেম) অনুষ্ঠিত হয়। ১১টি দেশের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৩টি দেশের প্রধানমন্ত্রী, ১৬টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল ও ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি ও আশিয়ানের সেক্রেটারি জেনারেল এই সম্মেলনে অংশ নেন।
তথ্যসূত্র : বাসস
মন্তব্য চালু নেই