সন্তান হারানো শোকের সান্ত্বনা এক লাখ টাকা!

গণমাধ্যমের কল্যাণে শুনেছি আজ বুধবার দুপুরে নির্মম নির্যাতনে নিহত শিশু রাজনের শোকাহত বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন আমাদের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।

তিনি হিত রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান ও মা লুবনা আক্তারকে সান্ত্বনা প্রদান করেন। এসময় তিনি রাজন হত্যার বিষয়টি মর্মান্তিক উল্লেখ করে দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং হত্যাকারীদের কোনো ধরনের ছাড় না দেয়ার কথা বলেন।ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ যা যা দরকার সব কিছু করার আশ্বাস দেন। এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে রাজনের বাবা-মায়ের হাতে এক লাখ টাকার অনুদান তুলে দেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই- এই লাখ টাকার শান্তনা কি সন্তান হারা রাজনের বাবা-মার জন্য যথেষ্ট? না, রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান তথা নাগরিকদের অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আরো কিছু করার ছিল! সেই সাথে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে, সত্যিকার অর্থেই কি রাজন হত্যার বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন হবে? না, কয়েকদিন পরেই অন্যান্য ঘটনার মত এটিও ধামাচাপা পড়ে যাবে । অবশ্য তা সময়ই বলে দিবে এর শেষ পরিণতি কী। যে দেশে হত্যার পর লাশ গুম হয়, খুনিদের রক্ষায় পুলিশের অর্থের রফা হয়, যেখানে খুনিরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, কখনো কখনো রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় খালাস পায়। সেখানে হতদরিদ্র রাজনের বিচার কতটা আলোর মুখ দেখবে তা সময়ই আমাদের বলে দিবে। এরপরও বিশ্বাস রাখতে চাই এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার হবে, শাস্তি পাবে পাষণ্ড মানবরূপী নরপশুরা।

যে যাই বলুক না কেন, আমার মতে, সন্তান হারানো রাজনের শোকাহত বাবা-মার জন্য প্রতিনিধি পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একলাখ টাকার অনুদান কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। যৌক্তিক বিচারেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর যতটুকুই করেছেন তা যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি গিয়ে রাজনের শোকাহত বাবা শেখ আজিজুর রহমান ও মা লুবনা আক্তারকে সান্ত্বনা দিতেন। তবে সেটা প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতার বহি:প্রকাশ হত। আর টাকার অনুদানই যখন দেয়া হবে তবে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে রাজনের মা-বাবার জন্য মাত্র এক লাখ টাকা কেন, এটা আমাদেরকে যেমনি বিস্মিত করেছে তেমনি ব্যথিত করেছে। কেননা, ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি অনেকের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেয়া হয়েছে। কিন্তু সন্তান হারানো রাজনের বাবার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মাত্র এক লাখ টাকা! বিষয়টি সত্যিই আমাদের মনে কষ্ট লাগার মতো বিষয়।

এক্ষেত্রে সেখানে না যাওয়ার বিষয়ে হয়তো প্রধানমন্ত্রী নিজের সময় স্বল্পতার কথা বলবেন। তুলে ধরতে পারেন রাষ্ট্রীয় কাজসহ নানা অজুহাতের কথা।কিন্তু যেখানে তিনি নিজের স্বজনদের সাথে সময় কাটাতে সুদূর লন্ডনে যেতে পারেন সেখানে সন্তান হারানো রাজনের শোকাহত বাবা-মার অবস্থান কি অনেক বেশী দূরে? ফলে এক্ষেত্রে কোনো অজুহাতই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর জানিনা কি মনে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনের বাবা-মাকে মাত্র এক লাখ টাকা অনুদান দিলেন।

প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার হলো- রাজনের বাবা-মা তো খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক। তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর মতো এত বড় ব্যক্তিদের যাবারই বা কি দরকার আছে। প্রতিমন্ত্রীর মত ব্যক্তিও না গেলেই বা তাদের কি করার আছে। রাষ্ট্র-সমাজে প্রতিবাদ চলছে, তাই হয়তো মুখ রক্ষায় দয়া পরবশ হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিনিধি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিকে পাঠিয়েছেন। আর যদি এখানে রাজনীতি, ক্ষমতার কোনো বিষয় থাকতো কিংবা রাজন যদি দলের কোনো নেতাকর্মির সন্তান হতো তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রী কাল বিলম্ব না করেই সেখানে গিয়ে শান্তনা দিতেন।

থাক এসব বিষয়। জনগণ তো রাজনের শোকাহত বাবা-মার পাশে দাড়িয়েঁছে । এটাই তাদের জন্য বড় শান্তনা। আজ যদি জনগণ এভাবে সোচ্চার না হতেন তবে হয়তো অন্যান্য রাজনদের ঘটনার মতো এই রাজন হত্যার ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যেত। লাশ উদ্ধার ও বিচারের জন্য তার বাবা মাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো।

আজ এব্যাপারে সবাই সোচ্চার। এরকম ক্ষোভ, এরকম প্রতিক্রিয়া মানুষের একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে, এতো স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে কোনো ঘটনায় চোখে পড়েনি। সিলেটে ভিডিও ক্যামেরার সামনে কিশোর রাজনকে পেটানোর পর তার মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা, যন্ত্রণা আর অসহায়ত্বের কথা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের গণমাধ্যমেও ঘটনাটি তা গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। যার ফলে অপরাধী-পুলিশের গোপন আতাতেঁও অন্য ১০টি ঘটনার মতো এটিকে আর ধামাচাপা দিতে পারেনি। হত্যার পর লাশ গুম করতে গিয়ে জনতার হাতে অপরাধী ধৃত, ১২ লাখ টাকার রফায় ৬লাখ টাকা নগদ পেয়ে মূলহত্যাকারী কামরুলকে বিদেশে পাড়ি দেয়ার সুযোগ করে দেয় পুলিশ। তবে শেষ রক্ষা হয়নি সেখানেও প্রবাসীরা ঘাতককে খোজেঁ ধরিয়ে দিয়েছে।

সবশেষে বলবো- যত কিছুই করি না কেন, আমরা কেউ শেখ আজিজুর রহমান ও লুবনা আক্তারকে তাদের কলিজার টুকরা আদরের ধন রাজনকে কোনদিনই ফিরিযে দিতে পারবো না। তাই বলে কি আমরা তাদের ভালভাবে একটু শান্তনা দিতে পারি না! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইচ্ছা করলে তো পারতেন সরাসরি গিয়ে রাজনের মাকে বুকে জড়িয়ে শান্তনাটুকু দিতে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আপনি এতটুকু করতে কার্পণ্য করবেননা।রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আপনার কাছ থেকেই এতটুকু সহানুভুতি আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি।

কলামলেখক ও সমাজবিষয়ক গবেষক। [email protected]



মন্তব্য চালু নেই