সঞ্জয়ের ৪ বছর ৩ মাস ১৪ দিনের কারাজীবনের গল্প

গত বছরেই জানা গিয়েছিল, এই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। তবে এর দুই দিন আগে আজ খোলা হাওয়ার স্বাদ পেলেন মুন্না ভাই। জেলখানায় একাধিক সুবিধা পেয়ে ১০১ দিন আগে অব্যাহতি পেলেন তিনি। জেলে থাকার সময় তাঁর খুব ভালো ব্যবহারে খুশি হয়ে তাঁকে ৭ মার্চের পরিবর্তে ২৫ ফেব্রুয়ারিতেই মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় জেল কর্তৃপক্ষ।

পুনের কারাগার থেকে আজ মুক্তি পেয়েছেন এই অভিনেতা। ওদিকে, জেল মুক্তির পর সঞ্জয়ের মন্তব্য, মু্ক্তির কোনও সহজ পথ নেই। পাঁচ বছরের সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮ মাস আগেই মুক্তি দেয়া হল তাকেই। আর সাজা খেটেছেন ৪ বছর ৩ মাস ১৪ দিন। স্ত্রী মান্যতা এবং পরিচালক রাজকুমার হিরানি সঞ্জয়কে জেল থেকে নিতে গিয়েছিলেন। আগেই জানিয়েছিলেন, মুম্বাইয়ে পৌঁছে তিনি যাবেন মায়ের সমাধিস্থলে। তারপর সেখান থেকে পালি হিলসে যাবেন নিজের বাড়িতে। তেমন ভাবেই দিনটি কাটানোর কথা জানালেন তাঁর পরিবারের সকলে।

জানা যায়, জেল গেট দিয়ে বের হওয়ার পর মাটিতে হাত স্পর্শ করে ইয়েরওয়াড়া কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে ফিরে তাকান সঞ্জয়। তারপর স্যালুট দেন কারা প্রহরীদের। সেখানেই যে কেটেছে তাঁর জীবনের মূল্যবান চারটি বছর।

এদিকে সঞ্জয় দত্তের মুক্তির খবর পেয়ে এতটাই খুশি জনতা যে, মুম্বাইয়ের এক রেস্তোঁরা মালিক তাঁর নামে স্পেশাল ডিশ বানিয়ে সারাদিন বিনামূল্যে তা সাধারণ মানুষকে খাওয়ানোর কথা জানিয়েছিলেন।
মুম্বাই বিস্ফোরণের সময় বেআইনি অস্ত্র রাখার দায়ে ধরা পড়েন সঞ্জয়। টাডা আইনে গ্রেফতার করা হয় অভিনেতাকে। সংশোধনাগারে থাকাকালীনও বিতর্কে জড়ান বলিউড সুপারস্টার। ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালের মে মাস থেকে ২০১৪ সালের মে মাস পর্যন্ত, একশো আঠারো দিন প্যারোলে মুক্ত ছিলেন তিনি। তবে, বাকি সময়টা কারাগারের ভেতরেই কাটিয়েছেন সঞ্জয়। তাঁর মুক্তিতে খুশির হাওয়া বইছে বলিউডে।

১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ পরপর ১৩টি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বাণিজ্যনগরী মুম্বাই। ১৯ এপ্রিল বেআইনিভাবে নাইন এমএম পিস্তল ও একে-ফিফটি সিক্স রাইফেল রাখার অপরাধে টাডা আইনে গ্রেফতার হন বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। ২০০৬ সালে সঞ্জয় দত্তকে ৬ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় টাডা আদালত। ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পান। ২০১৩ সালে সঞ্জয় দত্তর কারাদণ্ডের মেয়াদ ৬ বছর থেকে কমিয়ে ৫ বছর করে সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরেরই ১০ মে সাজা পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে সঞ্জয় দত্তকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৩-র ১৬ মে টাডা কোর্টে আত্মসমর্পণ করেন সঞ্জয় দত্ত। বার বার তাঁর প্যারোলে মুক্তি পাওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংশোধনাগারে ভাল আচরণের জন্য সঞ্জয়কে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মহারাষ্ট্র সরকার। যদিও তার দাবি, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার কারণে নিজের পরিবারকে বাঁচাতেই তিনি ওই অস্ত্রটি কিনেছিলেন। পাঁচবছরের সাজা হলেও, ভালো ব্যবহারের কারণে ১৪৪দিনের সাজা কমে যায় সঞ্জয় দত্তের।

কিন্তু এই খুশির মাঝেই সঞ্জয়ের ছাড়া পাওয়ার প্রতিবাদে জেলের বাইরে বিক্ষোভ দেখান কিছু লোক। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সঞ্জয়ের মুক্তির বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ওঠে সঞ্জয় দত্ত মুর্দাবাদ স্লোগানও। বিক্ষোভকারীদের ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। আজ সকালে জেলের বাইরে তাঁর মুক্তির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ হয়। একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছে।

তিনি বলিউড স্টার। এমনটাই জানে গোটা বিশ্ব। সিনেপ্রেমীদের কাছে তাঁর পরিচিতি, তিনি মুন্না ভাই। কিন্তু জেলে তাঁর পরিচয় কি ছিল। কারাগারে সঞ্জয় দত্ত ছিলেন একজন পেশাদার শ্রমিক, যার প্রতিনিয়ত রোজগার ছিল ৫০ টাকা। পুনের সেন্ট্রাল জেলে কাগজের ঠোঙা বানাতেন সঞ্জয় দত্ত। জেলে ঠোঙা বানিয়ে সঞ্জয় দত্তের মোট সঞ্চয় ৩৮ হাজার টাকা। কিন্তু দৈনন্দিন কাজে প্রায় গোটা সঞ্চয়ই ব্যয় করে ফেলেছেন সঞ্জয়। জেল থেকে যখন ছাড়া পেলেন, ৫৬ বছর বয়সী ‘সঞ্জু বাবা’র পকেটে তখন মাত্র ৪৫০ টাকা।

বলিউড স্টার সঞ্জয় দত্ত আজ যখন পুনের কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাঁর ঝুলিতে ছিল কাগজের ব্যাগ তৈরি আর রেডিও ডিস্ক জকি হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা। কারাগারের রেডিওতে একজন উপস্থাপক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন। ২০১৩ সালে তাকে পুনের ওই কারাগারে তার কারাভোগ শেষ করার জন্য পাঠানো হয়। যদিও অনেকে দাবি, সেলেব্রিটি হওয়ার কারণে তিনি অনেক বেশি প্যারোল ভোগ করেছেন। আজ তিনি সেই সাজা ভোগ শেষে বেরিয়ে এলেন।
কারাগারে সঞ্জয়ের সবচেয়ে নিরাপত্তার ওয়ার্ড, ‘ফ্যান্সি ওয়ার্ডে’ আট ফুট বাই দশ ফুটের একটি সেলে বাস করতেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের সেলগুলো ছিল ঠিক পাশেই। তাকে কারাবন্দীদের পোশাকই পড়তে হতো। তার কারাগারের বাইরে একটি ছোট বাগান ছিল, নিরাপত্তা রক্ষীদের নজরবন্দি হয়ে সেখানে তিনি হাঁটাচলা করতে পারবেন।

একজন কারাবন্দী জানিয়েছেন, তাকে কারাগারে সবাই ‘বাবা’ বলে ডাকতো। কারাগারে তিনি অনেক বই পড়তেন। লাইব্রেরী থেকে প্রতি সপ্তাহে তিনি দুইটি বই আনতেন। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ওঠার কিছু পর কারারক্ষীরা তার কাগজের ব্যাগ বানানোর জিনিসপত্র নিয়ে আসতো। নিউজ পেপার কেটে কেটে তিনি ব্যাগ বানাতেন।

দুপুরে তাকে কারাগারের অভ্যন্তরীণ রেডিও কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তিনি রেডিও জকি হিসাবে একটি প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করতেন। দুপুরের খাবারের পরও তিনি রেডিওকে কাজ করতেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাতের খাবার খেয়ে ৮টার মধ্যে তাকে নিজের সেলে ঢুকে পড়তে হতো। পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই তালাবন্ধ থাকতেন।

অবশেষে ভাইয়ের মুক্তির পর বাঁধনছাড়া আনন্দে আছেন সঞ্জয়ের বোন প্রিয়া। ভাইয়ের মুক্তির পর বোনের মন্তব্য, ‘২৩ বছরের অপেক্ষা শেষ। আমি চাপমুক্ত, বাবা আজ বেঁচে থাকলে ভাল হত।’ প্রিয়া বলেছেন, আজ তাঁদের বাবা বেঁচে থাকলে এটা দেখে খুবই আনন্দ পেতেন যে, দাদা অবশেষে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন।’

প্রিয়ার দাবি আজকের এই মুক্তির আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে এক ভয়ঙ্কর চাপ। এই মুক্তির আনন্দটা এমন এক উপলব্ধি যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

জানা গেছে, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আবারও রুপোলি পর্দা কাঁপাতে আসবেন সঞ্জয় দত্ত। সূত্রের দাবি, বহু পরিচালকই সঞ্জয়ের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁদের ছবি নিয়ে। তবে তিনি ঠিক কবে শুটিংয়ে ফিরতে চলেছেন, সেটা সবচেয়ে ভাল সঞ্জয়ই বলতে পারবেন।



মন্তব্য চালু নেই