সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র বেপরোয়া, উৎকণ্ঠা পুলিশে
সংঘবদ্ধ ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র এখন বেপরোয়া। সিরিজ কিলিং মিশন নিয়ে চক্রের সদস্যরা এখন মাঠে। নজিরবিহীন নিরাপত্তা-বেষ্টনী গড়ে তুলেও এদের রোধ করা যাচ্ছে না। রাজধানীর অন্যতম জনবহুল এলাকা গাবতলীর চেকপোস্টে একজন পুলিশ সদস্যকে খুন করার পর জনমনে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধী চক্রটি দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পেশাদার খুনি অপরাধী ছাড়াও উগ্রপন্থি নিষিদ্ধ সংগঠনের দুর্ধর্ষ সদস্যরা এ চক্রে রয়েছেন বলে তাদের আশঙ্কা। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই যারা পুলিশ খুন করে, তারা ছোট মাপের অপরাধী নয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ অপরাধীরাই এমন বেছে বেছে মুহূর্তেই খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা খুনের ঘটনায় সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত। এ বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের আইজি।
অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই বিদেশি ও খিজির হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো অজানাই রয়ে গেছে। চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার রহস্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে না পারায় একই ধরনের ঘটনা ঘটছে বারবার। অপরাধীদের গ্রেফতার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ সদস্যরাও এখন অপরাধীদের টার্গেটে। পুলিশের ভিতর ভয়ভীতি ছড়িয়ে দিতে এমন খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে বলে তারা মনে করছেন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক খুনের পর থেকেই মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। প্রায় এক মাসের মধ্যেই দুই বিদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পরই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’। এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। এর পরই বাড্ডায় বাসার ভিতর খুন হন খিজির খান। বিদেশি নাগরিক খুনের পর পুরো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রাজধানীর স্পর্শকাতর এলাকায় মোতায়েন করা হয় বিজিবি। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ খুনের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা হতবাক।
তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। গতকাল পদস্থ কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন দফায় দফায়। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। চেকপোস্টগুলো আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জনবল বাড়ানো হয়েছে গতকাল থেকেই। পুলিশকে দলবদ্ধভাবে চেকপোস্টে তল্লাশি চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেও অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না পুলিশ। আর যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর তদন্তে কোনো কূলকিনারাও পুলিশ করতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজিরবিহীনভাবে অবনতির দিকে এ বিষয়টি আর দেশের ভিতরের খবর নয়। দুই বিদেশি নাগরিক খুনের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতির খবর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও আলোচিত হয়ে উঠেছে। পুলিশ খুনের পর সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় দুই বিদেশি খুন, খিজির হত্যা ও জঙ্গি উত্থান ছিল আলোচিত। সভায় ইতালি ও জাপানের দুই নাগরিককে হত্যায় যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে নির্দেশ দেন পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, অতীতে বাংলাদেশ পুলিশ জঙ্গিবাদ, চরমপন্থি, নাশকতাকারী ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। সেই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই এ দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হতে দেওয়া হবে না। আমাদের দেশকে নিয়ে সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা হবে। দেশে জেএমবি, হুজিসহ বিভিন্ন নামে জঙ্গিবাদের উত্থান যাতে না ঘটে সে জন্য সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ওই বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যে পুলিশ খুনের পর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতির পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো মহলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। বৈঠকে আইজিপি বলেছেন, কেউ ব্যক্তিগতভাবে মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও বাংলাদেশে আইএসের কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই।
২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে তাভেলা সিজার (৫১) নামে ইতালির এক নাগরিক দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। ওই দিন সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৯০ নম্বর সড়কে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে স্থানীয় ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাভেলা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি সংস্থার প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে গুলশানে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাভেলা খুনের আগে বাংলাদেশে অবস্থানরত যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের সতর্ক করা হয়। দেশটির সরকারি ওয়েবসাইট গভ ডট ইউকেতে দেওয়া এক নির্দেশনায় বাংলাদেশে সাধারণ সন্ত্রাসী হুমকির কথা বলা হয়। বিদেশিদের যাতায়াতের স্থানসহ আরও বিভিন্ন স্থানে নির্বিচার হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে ওই নির্দেশনায়। এতে যুক্তরাজ্য তার নাগরিকদের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ও অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেল এবং কনফারেন্স সেন্টারে নাগরিক জমায়েতে যোগদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়। ইতালীয় নাগরিক হত্যার দাগ যেতে না যেতেই ৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রংপুরের মাহিগঞ্জের নাচনিয়া বিলে হোশি কোনিও নামে এক জাপানি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় ঢুকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবির) সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মধ্যবাড্ডার জ-১০/১ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ওই খুনের ঘটনা ঘটে। বাড়িটির তিনতলাও তছনছ করে দুর্বৃত্তরা। এরই মধ্যে পুলিশের চেকপোস্টে খুন হলেন এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা।
মন্তব্য চালু নেই