শ্রদ্ধা নিবেদনে ফুল নয়, শুকানো হচ্ছে ধান
রাজশাহী মোহরপুর উপজেলার মুগরইল গ্রাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাক-হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এখানে একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ জনকে। দিনব্যাপি চলে লুটপাট। তাণ্ডব চালিয়ে পাক-বাহিনীর সদস্যরা সারা গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
শহীদদের স্মৃতিতে ৬ থেকে ৮ বছর আগে উপজেলা প্রশাসন নির্মাণ করেছিল স্মৃতিস্তম্ভ। তবে ওই স্মৃতিস্তম্ভের এখন বেহাল দশা। স্মৃতিস্তম্ভে এখন শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের বদলে ধান শুকানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই না, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ার ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে যাওয়া রাস্তাটি এখনো পাক হয়নি। স্মৃতিস্তম্ভটির বেহাল দশায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আছে ক্ষোভ।
মোহনপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় রাজশাহীতে যে কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে মুগরইল গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি অন্যতম। এ গ্রামে এক সঙ্গে ১৫ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। স্মৃতিস্তম্ভটি সেই ঘটনার স্মৃতি বহন করে আসছে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগের প্রায় ৮ বছর আগে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান আরো জানান, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে প্রশাসন। এরপরে সেই শহীদ মিনার রক্ষণাবেক্ষণের কোনো দায়িত্ব নেয়া হয়নি। মাত্র এক কিলোমিটারের মতো দূরত্ব হলেও স্মৃতিস্তম্ভে যেতে যে রাস্তাটি তা এখনো পাকা করা হয়নি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন জানান, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর মুগরইল গ্রামে ওই ভয়াঙ্কর ঘটনাটি ঘটে। পাক হানাদেরদের দোসর স্থানীয় রাজাকার দাউদ আলী, নুরে আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন রাজাকারের প্রত্যক্ষ মদদে মুগরইল গ্রামের নজরুল শেখ, ইদ্রিস শেখ, হাবিবুর রহমান, রশিদ শেখ, জেকের আলী শেখ, বছির আলী শেখ, মফির উদ্দিন, ফফির উদ্দিন, ইয়ানুচ আলী, নুরুজ্জামান, সেকু সরদার এবং পবা উপজেলার মদনহাটি গ্রামের কুশব আলী মণ্ডল, মেছের আলী মণ্ডল, রিয়াজ আলী সরদার এবং শ্রী বৈদ্যনাথ ঋষিসহ ১৫ জনকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে হাত পা বেধে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
তারা আরো জানায়, শুধু তাই না পাক-বাহিনী ওই এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মুগরইল গ্রামে চালায় লুঠতারাজ, ধর্ষণ। গ্রামটি পাক বাহিনীরা অগ্নিসংযোগ করে ভষ্মিভূত করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ঘটনার দিন পাক হানাদার বাহিনী গ্রামের দিকে আসছে। এ কথা শুনেই গ্রামবাসীরা এদিকে সেদিকে ছুটে পালায়। অনেকেই আশ্রয় নেয় পাশের জঙ্গলে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পাক বাহিনী অনেক আগেই জঙ্গলসহ গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রামের চলে বাড়ি বাড়ি অভিযান। হত্যা করা হয় গ্রামের ১৫ ব্যক্তিকে। একই সঙ্গে চলে সোনার গহনা ও টাকা পয়সা লুটপাট। গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচারসহ গ্রাম আগুন ধরিয়ে ভস্মিভূত করা হয় পুরো গ্রামকে।
ধংসযজ্ঞ থামার পরে যারা জীবিত ছিলেন তারা গ্রামে ফিরে আসেন। তখন নিহতদের দাফনের জন্য গ্রামবাসী কাফনের কাপড়ও জোটাতে পেরেছিল না। কাফন ছাড়াই প্রতি কবরে দাফন করা হয়েছিল ১৫ জনকে।
তবে হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন রাজাকার এখনো বেঁচে আছেন। মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয়দের দাবি তাদের বিচারের। এদাবি থেকেই শহিদ বশির উদ্দিন শেখের ছেলে মেজারুল শেখ গত ২০০৮ সলের ২২শে জুন তিনি ১৯ জন যুদ্ধপরাধীর বিরুদ্ধে রাজশাহী অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মোহনপুর থানা পুলিশকে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। মোহনপুর থানার পুলিশ দীর্ঘ তিন মাস তদন্ত শেষে একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করে।
ওই মামলায় রাজাকার দাউদ হোসেন এবং নুরে আনোয়রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়। বিচারটির এখন কোনো অগ্রগতি নেই।
স্মৃতিস্তম্ভটির বিষয়ে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন আয়েন জানান, খুব তাড়াতাড়ি শহীদ মিনারটি সংস্কারের কাজ হাত দেয়া হবে। পাশাপাশি স্মৃতিস্তম্ভটিতে যেতে যে রাস্তাটি কাঁচা আছে তা পাকা করা হবে।
মন্তব্য চালু নেই