শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে আওয়ামী লীগকে উজ্জীবিত করেছে শেখ হাসিনা

সেদিন ফিরেছিলেন তিনি দুঃখিনী মায়ের কোলে। বাংলা মায়ের বুক ভাসিয়েছিলেন নয়ন সিক্ত জলে। স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে হাল ধরলেন বাবার তিল তিল করে গড়া সংগঠনের। ধরে আছেন আজও। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার সাড়ে তিন দশকের নেতৃত্বে আজ আরো বেশি সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ।খবর: জাগোনিউজ।

১৭ মে, ১৯৮১ সাল। ভারী বর্ষণ আর ঝড়ো হাওয়ায় ঢাকার রাজপথ সেদিন সিক্ত হয়ে উঠেছিল। অঝোর বারিধারা যেন সর্বহারার বেদনাকেই স্মরণ করে দিচ্ছিল। কিন্তু না, তা ছিল আনন্দ অশ্রু। ছিল স্বজনকে ফিরে পাওয়ার বাংলা মায়ের আবেগের কান্না।

ওই দিন বিমানবন্দরে নেমেই কাঁদলেন, কাঁদালেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। বৃষ্টি জলে নয়নের জল মিশে যেন একাকার। সেদিন হৃদয়বিদারক এমন দৃশ্যে করুণ সুর লহরি বেজে উঠলেও জৈষ্ঠের দাবদাহ নিমেষেই যেন শীতলতায় বদলে যায়।

ঢাকার সমস্ত রাস্তা সেদিন মিলেছিল বিমানবন্দরে। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাখো জনতা রাস্তায় নেমেছিল বঙ্গবন্ধু কন্যাকে স্বাগত জানাতে।

গোটা ঢাকা যেন পরিণত হয়েছিল এক মহাজনসমুদ্রে। দীর্ঘ ছয় বছর প্রায় নির্বাসিত প্রবাস জীবন ছেড়ে আটপৌরে গৃহবধূ শেখ হাসিনা ছুটে এসেছিলেন বাংলা মায়ের কোলে।

প্রত্যাবর্তনের দিন বিমানবন্দরে নেমেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আজ আমি এসেছি বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছু নেই।’

দেশে তখন গণতন্ত্রের বদলে সামরিক শাসন। সামরিক শাসনের এমন দিনে শেখ হাসিনা এসেছিলেন মুক্তির দিশারী হয়ে। আঘাত করলেন গণতন্ত্রের বন্ধ দুয়ারে। হাল ধরলেন বাবার হাতে তিল তিল করে গড়ে ওঠা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের।

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অপর নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম। শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

জন্মের পর থেকেই একেকটি ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একেকটি ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন এবং ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে একক নেতৃত্ব গড়ে তোলে সংগঠনটি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও দলটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।

জন্মের পর থেকেই ভাঙন, নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আজ ৬৭ বছরে পা দিয়েছে দলটি। রাজনীতির এক ক্রান্তিকালে ১৯৬৬ সালে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েই সাহস, সততা আর নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় শুধু দলই নয়, গোটা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি। যার প্রমাণ মেলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম দৃঢ়তা আর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণেই দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দলে মহাবিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৭৬ সালে ঘরোয়া পরিবেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল তখন খুবই দুর্বল। এমন ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার আগেই বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়।

১৯৮৩ সালে আবারো আঘাত আসে দলটির ওপর। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ দলত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

দায়িত্ব পেয়েই বাবার দেখানো পথে দলকে পুনর্গঠন করতে থাকেন শেখ হাসিনা। দলের মধ্যে একক নেতৃত্বে অবস্থান করেন তিনি। দীর্ঘ সংগ্রাম আর আন্দোলনের পর তারই নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দলের সভাপতি পদে থেকেই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দলকে শক্তিশালী করতে পারলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের কাছে পরাজয় বরণ করে তার দল। ক্ষমতার বাইরে থেকে নিজেদের ভুল শুধরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ফের গণমানুষের দলে রূপ নেয়।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলের মধ্যে ফের ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। মাইনাস টু ফর্মুলায় শেখ হাসিনাকে দল থেকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সেই ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগেরই জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারো কারো ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু দলের প্রতি আনুগত্য এবং তৃণমূলের নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার হাতেই দলের দায়িত্ব থেকে যায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল সংগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে স্বপদে বহাল রেখে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে।

সেই কমিটির অধীনেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংবিধান রক্ষার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। আর শেখ হাসিনা হন তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী।

ধারাবাহিক নেতৃত্বে শেখ হাসিনা আজ সরকারের মধ্যে যেমন অধিক শক্তিশালী, তেমনি দলের মধ্যে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। সুদিনে সবাইকে পাশে নিয়ে আর দুর্দিনে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বন্ধুর পথে এগিয়ে চলছেন। কৌশলে পাশে নিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই বিরোধিতাকারী বামপন্থী নেতা ও সংগঠনকে।

সংগ্রামের এ পথ চলায় বহুবার হামলার শিকার হয়েছেন শেখ হাসিনা। সাড়ে তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য মামলার আসামিও হতে হয়েছে তাকে। গ্রেফতার হয়েছেন একাধিকবার। তবুও যেন ইস্পাতসম মনোবল। আর এমন মনোবলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাতেই যেন অধিক নিরাপদ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমদু চৌধুরী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ অধিক শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ। তার নেতৃত্বের কারণে দল সকল দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি হাল ধরেছেন বলেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ ও জাতি আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই