শুভ জন্মদিন নন্দিত হুমায়ূন ফরীদি

‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’র সেরাজ তালুকদার, ‘সংশপ্তক’এর কানকাটা রমজান কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’র একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মানুষ মনে রাখবে অনেকদিন। যিনি এই চরিত্রগুলোকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছেন, তিনি হুমায়ুন ফরীদি। আমাদের অভিনয় জগতের জাদুকর কিংবা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা।

আজ তার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৬৪ বছরে পা রাখতেন। জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে হৃদয়ের গভীর প্রেম আর অবিরাম ভালোবাসায় আওয়ার নিউজ বিডি পরিবার স্মরণ করছে এই বরেণ্য অভিনেতাকে।

আজ শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হবে হুমায়ূন ফরীদির নাম- সেটি অনুমেয়। হবে অনেক আলোচনা ও স্মরণানুষ্ঠানও। তারই ভিড়ে কেউ কেউ আজ ভীষণ মন খারাপ করবেন প্রিয় মানুষ, প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সঙ্গীর স্মরণে।

এক দীর্ঘ কর্মময় বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবন ছিল হুমায়ুন ফরীদির। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চে সমান দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। চমকে দিয়েছেন, তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দেশ-বিদেশের লাখো-কোটি ভক্ত-দর্শকের মন।

হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ২৯ মে, ১৯৫২, নারিন্দা, ঢাকা। বাবা এ.টি এম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরী বোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে ফরিদীকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। মা বেগম ফরিদা ইসলাম গৃহিনী।

ছোটবেলায় ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরিদীকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হতো। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল পাস দিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন। এলো একাত্তুর, চলে গেলেন যুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ পরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরেননি।

টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব নাট্যকার সেলিম আল দীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্য উৎসব আয়োজনেরও প্রধান সংগঠক ছিলেন ফরীদি। সেখানে ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরীদি। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে।

সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে ফরিদী মঞ্চে উঠে আসেন। অবশ্য এর আগে ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ অভিনয় করেন। মঞ্চে তার সু-অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শকুন্তলা’, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে স্ব-নির্দেশিত ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরিদীর ঢাকা থিয়েটারের জীবন।

এরপর আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরিদীর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। যারা দেখেছেন বিটিভি’র ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩) নাটকে সেরাজ তালুকদারের কথা মনে আছে নিশ্চয়। সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় এই নাটকে ফরিদীকে দেখা যায় টুপি দাড়িওয়ালা শয়তানের এক জীবন্ত মূর্তি রূপে। ‘আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ কিংবা ‘দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান’-এই সংলাপগুলো এখনও মন ছুঁয়ে যায়। সেগুলো নাকি আশির দশকে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলো।

এরপর শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮)-এ ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে-ফরিদীর অনবদ্য অভিনয় কেউ ভোলে নি। ভুলা কি যায়! অসম্ভব! ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘বকুলপুর কতদূর’ (১৯৮৫)’, ‘মহুয়ার মন’ (১৯৮৬), ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’ (১৯৮৬) ‘একদিন হঠাৎ’ (১৯৮৬), ‘ও যাত্রা’ (১৯৮৬) ‘পাথর সময়’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’ (১৯৯৩), ‘চন্দ্রগ্রন্থ’ (২০০৬), ‘কাছের মানুষ’ (২০০৬), ‘কোথাও কেউ নাই’ (১৯৯০), ‘মোহনা’ (২০০৬), ‘ভবেরহাট’ (২০০৭), ‘জহুরা’,‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘শৃঙ্খল’ (২০১০), ‘প্রিয়জন নিবাস’ (২০১১), ‘অক্টোপাস’, ‘আরমান ভাই দি জেন্টেলম্যান’ (২০১১)-আরো আরো অনেক নাটকে বিরামহীনভাবে দর্শকদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩), ‘ভবের হাট’ (২০০৭), ‘শৃঙ্খল’ (২০১০) ইত্যাদি নাটকে তিনি ছিলেন অনবদ্য।

নব্বইয়ের গোড়া থেকেই হুমায়ুন ফরিদীর বড় পর্দার জীবন শুরু হয়। বাণিজ্যিক আর বিকল্প ধারা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে প্রথম ছবি তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। এরপর তার অভিনীত সিনেমার মধ্যে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন,’ ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘বিচার হবে’ (১৯৯৬),‘মায়ের অধিকার’ (১৯৯৬) ‘আনন্দ অশ্র“’ (১৯৯৭), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তুরের যীশু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নেগেটিভ, পজেটিভ অর্থাৎ নায়ক-খলনায়ক দু চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল, এক কথায় ভার্সেটাইল। এক সময়ে মানুষ আর নায়ককে না, এক ভিলেনকে দেখতেই হলে যেতেন। সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলনায়ক ছিলেন ফরিদী। এমন বিরল ইতিহাস আর কোনো চলচ্চিত্র খল অভিনেতা দেখাতে পারেননি।

মানতে কষ্ট হয়, বিশ্বাসও হতে চায় না, তিনি নেই। আমাদের হুমায়ুন ফরীদি নেই! নেই কথাটা এখানে বড় নিষ্ঠুর। যার অভিনয় এত ভালবেসেছি, যাকে এত ভালবেসেছি সবাই সেই তাকে ছাড়াই দিব্যি চলে যাচ্ছে দিনগুলো!

২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের আগুনে বিষাদের কালো আঁভা ছড়িয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন অভিনয়ের কিংবদন্তী পুরুষ হুমায়ুন ফরিদী। কাঁদিয়েছিলেন কোটি ভক্তকে। সেদিন ফরিদীর বাসভবন পরিণত হয়েছিলো মানুষের সমুদ্রে। শোবিজের নানা অঙ্গনের মানুষেরা সেদিন লোক লজ্জা ভুলে আহাজারি করে কেঁদেছিলেন ফরিদীর জন্য। এভাবে আর কোনো শিল্পীর জন্য কান্না দেখেনি এদেশের মানুষ। হয়তো ব্যক্তিজীবনে খুব বেশি একা ছিলেন বলেই অনেক বেশি মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি।

প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত জগত থাকে। সে জগতে ভালবাসার অভাব থাকতেই পারে অভিনেতা ফরীদির। তবে জনপ্রিয়তার আকাশে হুমায়ুন ফরিদী চিরকাল ভালাবাসায় সিক্ত হবেন তার কোটি ভক্তদের কাছে।



মন্তব্য চালু নেই