শিশু জিহাদ হত্যা, শিক্ষার অসারতা ও দোষীদের শাস্তির দাবি
“পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্ত ধন, নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন” রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো আবার প্রমাণিত হল শিশু জিহাদ নাটকের অবসানের পর। ওয়াসার পাইপে পড়ে শিশু জিহাদ নিহত হওয়া একটি হত্যাকাণ্ড, এর ঘটনাধারা আমাদের মুখস্থ-নির্ভর শিক্ষার অসারতাকেই প্রমাণিত করল। বাক্সভিত্তিক বুদ্ধি ও সিলেবাসকেন্দ্রিক জ্ঞান ও মুখস্থনির্ভর অধ্যয়ন দেয় ডিগ্রি, দেয় চাকরি। কিন্তু ঐ বাক্সভিত্তিক বুদ্ধি ও সিলেবাসকেন্দ্রিক জ্ঞান ও মুখস্থনির্ভর অধ্যয়ন প্রাপ্ত ডিগ্রি কোনো কাজে লাগে না।
আমাদের সর্বোচ্চ সার্টিফিকেটধারী প্রকৌশলী, জাহাঁবাজ আমলা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা যখন শিশু জিহাদ উদ্ধারের ঘটনা স্থগিত করল। তাদের অত্যাধুনিক ক্যামেরা, ক্যাচার-ম্যাচার সব কিছু দিয়ে আর চেষ্টা করেও কালক্ষেপণ নিষ্প্রয়োজন মনে হল, গর্তে শিশুর অস্তিত্ব নেই বলে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হল, তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় বেসরকারি সংস্থা আইকনের কর্মীরা শিশুটিকে উদ্ধার করেন। উদ্ধারের পর তারা অভিযোগ করে বলেছেন, শুক্রবার রাতেই শিশুটিকে তারা উদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধার কর্মীরা তাদেরকে শিশুটিকে উদ্ধার করতে দেয়নি। খাঁচা আকৃতির বিশেষ একটি যন্ত্র দিয়ে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। আইকন কোম্পানির ফারুকের নেতৃত্বে উদ্ধারে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্রটি তৈরি করেন আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুলকাদেরচৌধুরী, আব্দুলমজিদ, শরীফুল, রহমতও লিটুসহ আরো কয়েকজন। শুক্রবার ৩ ঘণ্টার চেষ্টায় এই খাঁচা-আকৃতির যন্ত্রটি তৈরি করেন তারা। তিনটি লোহার রড দিয়ে তৈরি যন্ত্রটিতে তারা একটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন। পাইপে ফেলানোর সময় খাঁচার মুখ খোলা থাকে। উপরে উঠানোর সময় সেই খাঁচার মুখটি আবার বন্ধ হয়ে যায়।সেভাবেই খাঁচার সঙ্গে উঠে আসে জিহাদের লাশ। এ টিমের সদস্য আব্দুল মজিদ একজন ইলেকট্রিশিয়ান। রানাপ্লাজা ধসের পর উদ্ধারকারী টিমের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাড়ি দিনাজপুর। আর শরীফুল ইসলাম একজন গাড়ি ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে।
আমি টেলিভিশনে স্বেচ্ছাসেবীর দল উদ্ভাবিত যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য ও আকার-আকৃতি-প্রকৃতি দেখেছি। নিতান্তই যৌক্তিক একটি সিম্পল যন্ত্র যা ২৩/২৪ ঘণ্টা ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধার কর্মীদের প্রচেষ্টায় ভুল উপসংহারের পর আইকনের স্বেচ্ছাসেবীরা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় শিশুটির দেহ তুলে আনতে সক্ষম হল। আসলে, তাদের যন্ত্রটিতে সুড়ঙ্গটি যন্ত্রটি সরু হয়ে ঢুকে তারপর ফেরার পথে প্রসারিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু নিয়ে আসার বিষয়টি দেখতে শুনতে সিম্পল হলেও এর প্রযুক্তিগত কার্যকারিতা, সফলতা, সর্বোপরি উদ্ভাবনীয়তা চমৎকৃত করে। ইলেক্ট্রেসিয়ান আব্দুল মজিদদের তাৎক্ষণিক উদ্ভাবিত যন্ত্রটি তার সাক্ষরও রেখেছে। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন ওরা ৩ জন এবং খাঁচা, ক্যামেরাও কিছু উদ্যমী তরুণ।
অন্যদিকে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধার কর্মীদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ। কারণ তাদের অর্জিত জ্ঞান কিছু মুখস্ত ফর্মুলা তথা রোট লার্নিং-নির্ভর,যাতে সমস্যার বাস্তবতা অনুযায়ী উদ্ভাবনী চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত তো করেই না বরং তার মৃত্যু ঘটায়। তারই ফল স্বরূপ তাদের হাতে সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যাটাই ভুল বলে স্বীকার করা হয়। কারণ তারা সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে না। সমস্যা সমাধান তো বহুদূরের কথা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করার মাধ্যম উচ্চ ফলাফল অর্জনকারীরা জাঁদরেল অবস্থানে সেজেগুজে চেয়ার আঁকড়ে বসে আছেন। বিপদে তারা কী উদ্ধার করবেন। মুখস্থ নির্ধারিত ফর্মুলায় যদি সমস্যা সমাধানের কোনো কথা থাকে তা চেষ্টা করবেন। সামান্য এদিক ওদিক হলে আর সমস্যাাটা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই পাইপের মধ্যে জিহাদ নেই। এটি একটি নিছক গুজব বলে হম্বিতম্বি। উদ্ধার অভিযান বাদ। এভাবে মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করার মাধ্যম উচ্চ ফলাফল অর্জনকারীরাই দেশের সব কিছু চালাচ্ছে। আর মারছে মানুষ। তাদের কী দোষ। তারা যা শিখেছেন মানে মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করেছেন তার বাইরে যাবেন কীভাবে? মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা বাইরে যাওয়া তো ঠিক না। এটাই তারা শিখেছেন। তারা প্রয়োজনে বিশাল বিশাল পুঁথিতে দেওয়া তত্ত্ব ও মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা দেখিয়ে দিতে পারেন। যেগুলো মুখস্থ করে তাাঁরা অনেক বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যা তাদের এই চেয়ারগুলোতে বসিয়েছে।
আমাদের শিক্ষা থেকে কবে এই মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করে সার্টিফিকেট অর্জনের ধারা দূর হবে?
কবে শিশু জিহাদের মতো দেশের শিশু সন্তানেরা, তথা নাগরিকেরা নানান সেক্টরে কর্মরত / অপকর্মরত মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জনকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাবে?
সাইক্লিক ওর্ডারে কি শুধু মুখস্থ বিদ্যা ও নির্ধারিত ফর্মুলা মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জনসর্বস্ব শিক্ষার ধারাই চলতে থাকবে? আর সেখান থেকে বের হবে কাঠমোল্লার মতো কিছু ডিগ্রিধারী জাহাঁবাজ কর্মকর্তা? যারা নিজ নিজ সেক্টরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বা প্রতীকীভাবে জাতিকে নিয়মিত হত্যা করে যাবে?
শিশু জিহাদ যে আমাদের রাষ্ট্রীয় বা পাবলিক ব্যবস্থাপনার হাতে নিহত হল, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাই এই হত্যার বিচার ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
পুনশ্চ: আমি সবকিছু/অধিকাংশ সমস্যার পেছনে শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। কারণ শিক্ষাই মেরুদণ্ড কথাটা আমি বিশ্বাস করি। আর মেরুদণ্ডে গলদ থাকায় আমরা উঠে দাঁড়াতে পারছি না। আমরা যদি জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়াতে চাই তাহলে শিক্ষার উন্নত মান নিশ্চিত করতেই হবে।
[ লেখকের নিজস্ব মতামত ]
মন্তব্য চালু নেই