শিশুর মাথা কেটে নিয়ে এ আবার কেমন উৎসব?
‘গাজন বা চড়ক’ আসলে একটি লোকাচার বা লোকসংস্কৃতি। মূল কথা হল, জগৎ-সংসারকে ভোগ করতে হলে ত্যাগের মাধ্যমেই তার রসাস্বাদন করতে হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিরা ফাগুন দিনের ফাল্গুনী রচনা করে রাধাকৃষ্ণকে সাক্ষী রেখে চৈত্রমাসে শিবের সাধনা করে। স্থান কাল ভেদে কেউ বলত শিবের গাজন, কেউ বলত নীলের গাজন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটি গ্রামে শিবের গাজন পালনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সে দেশের লেখক শান্তনু গাঙ্গুলি। আর সেই লেখাটি প্রকাশ করা হলো আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য।
খবরটা হঠাৎ কানে এসেছিল। সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারিনি। আবার এটাও ভেবেছিলাম‚ অসম্ভব ঘটনাই তো ঘটে চলে সব সময়। রাত থাকতেই সেই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বর্ধমান স্টেশন থেকে বাইকে চল্লিশ মিনিটের মতো রাস্তা। গ্রামে ঢোকার আগে থেকেই একটা অদ্ভুত রকমের ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। কেমন যেন দ্রিমি-দ্রিমি একটা রহস্যজনক আওয়াজ।
আগে থেকেই খবর নিয়ে রেখেছিলাম। বর্ণনা অনুয়ারী মূল রাস্তা থেকে একটা অপরিসর গলি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা যাওয়ার পর একটা বিরাট গাছের তলায় এসে দাঁড়ালাম। গাছটিকে ঘিরে লোকজনের ইতস্তত জটলা দেখে বুঝলাম‚ এটাই সেই জায়গা‚ আকাশের রঙ তখন সবে বদলাতে শুরু করেছে। হাল্কা আর সুগন্ধি ধুনোর ধোঁয়া: তারমধ্যেই দেখলাম একটা লোক গাছ থেকে একটা নোংরা চটের বস্তা নামিয়ে আনছে। এগিয়ে গেলাম। প্রচুর মানুষ সেখানে ভিড় করে আছে। কাছে যেতে একটা তীব্র দুর্গন্ধ নাকে এলো।
বস্তা থেকে বেরোল কয়েক দিন আগে মারা যাওয়া ‘মানুষ’-এর পচাগলা দেহ এবং দেহাংশ। বিশেষত কাটা মাথা। একটা শিশুর মৃতদেহও বার করা হল। সেখান থেকে মাংস গলে-গলে পড়ছে।
এবার ওই দেহ এবং দেহাংশ দড়িতে বেঁধে গোটা গ্রামে উল্লাস করতে-করতে ঘুরবে কিছু মানুষ। পুণ্যলোভী মানুষ। যাদেরকে বলা হয় ‘সন্ন্যাসী’। এটি আসলে হিন্দু ধর্মীয় আচার। চৈত্র সংক্রান্তি‚ অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন পালিত হয় এই শিবের গাজন উৎসব। অনেক জায়গাতেই শিবের গাজন হয়। কিন্তু বর্ধমান কুড়মুন গ্রামের গাজন একটু অন্যরকম ভাবে পালিত হয়। একই ভাবে হয় পার্শ্ববর্তী পলাশী‚ নাসিগ্রাম‚ভাণ্ডারডিহি-সহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রামে। কিন্ত ভয়াবহতার দিক থেকে কুড়মুন এদের সবাইকে ছাপিয়ে যায়। আর সেই কারণেই কুড়মুনের গাজন সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত (বা কুখ্যাত)। সেই পৈশাচিক গাজন দেখার রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার।
হিন্দু লোকাচারে গাজনের রীতি খুবই পুরোনো। প্রচলিত মতবাদ অনুয়ারী‚গাজনের সন্ন্যাসীরা (বেশিরভাগই অবশ্য শুধু চৈত্র মাসের জন্য ‘সন্ন্যাস’ নেন) চৈত্র সংক্রান্তিতে ভূত অর্থাৎ শিবের শিষ্য হয়ে যান। বিশ্বাস করা হয়‚ মৃতদেহ বা দেহাংশের মধ্যে তখন যার দেহ‚ তার আত্মা ফিরে আসে। তাই শিবের শিষ্য নন্দি-ভৃঙ্গির অনুকরণে চলে এই পিশাচ-তাণ্ডব।যদিও এই বিষয়ে মতপার্থক্য আছে।
ফিরে আসি কুড়মুন গ্রামের গাজনের কথায়। অতি দুর্গন্ধের মধ্যে মত্ত অবস্থায় গাজন-সন্ন্যাসীরা গ্রামের বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঘুড়ে জড়ো হন মূল মন্দির প্রাঙ্গনে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অগণিত মানুষ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা গাজন দেখতে আসেন। আর্থিক ভাবে যথেষ্ট ‘উন্নত’ এবং ‘শিক্ষিত’ এই গ্রামের মানুষের কাছে এই উৎসব গর্বের এবং ঐতিহ্যের। তাই গ্রামের যেসব মানুষ কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন তারাও এই সময় গ্রামে আসেন। যে রাস্তা দিয়ে সন্ন্যাসীরা যান‚ তার দু ধারে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ন্যাসীরা মাঝে মাঝে তাদের গায়ে সেই মৃতদেহ ছুঁইয়ে দেন।
দর্শনার্থীদের গায়ে তখন সেই পচা-গলা দেহাংশ লেগে যায়। আমার পাশে দাঁড়ানো একজনের তেমনই ঘটনা ঘটেছিল। এমনকী আমি যখন একদিকের রাস্তা থেকে আসা শোভাযাত্রার ফটো তুলতে ব্যস্ত ছিলাম; ঠিক তখনই পাশ থেকে একজন এসে আমার গায়ে একটা কাটা মাথা ছুঁইয়ে দেয়। আমার হাতে‚ ক্যামেরায় সেই পচা-গলা মাংস লেগে যায়। কিন্তু এই সবই খুব সাধারণ ঘটনা। গ্রামের লোকেরা এতে একটুও অবাক হয় না। তাই তো কত বাবা-মা তাদের ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে এই শোভাযাত্রা দেখতে আসে। কেউ কেউ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণও করে। অনুষ্ঠানে যাতে কোনওরকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রচুর পুলিশ মোতায়েন থাকে। যদিও এই অনুষ্ঠানটাই বেআইনি। কোনও সভ্য সমাজে তো এটা চলতে পারে না।
বছর দুয়েক আগে বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ে পুলিশ আটজনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ‚ গাজনের জন্য এই সন্ন্যাসীরা মৃতদেহ চুরি করে আনছিলেন। রাস্তায় লোকেদের দুর্গন্ধে সন্দেহ হয় এবং তারা পুলিশে খবর দেন। সে বছর গাজনের আনন্দ একটু কম হয়ে যায়। কিন্তু মৃতদেহ সেই বছরেও ছিল‚ এই বছরেও থাকবে। মৃতদেহের যোগানের কারণে কখনো এই উৎসব বন্ধ হবে না।
আগে আরো বেশি মৃতদেহ থাকত। কারণ এই সময়েই আগে বসন্ত রোগে প্রচুর মানুষ মারা যেতো। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। শোনা যায়‚ একটি শিশু মারা যায়। তার বাড়ির লোক কোনোরকম আওয়াজ না করে রাতের অন্ধকারে শবদেহ দূরের একটি গ্রামে কবর দিয়ে আসে (হিন্দু ধর্মানুসারে বয়স পাঁচ বছরের কম হলে তাকে দাহ করার বদলে কবর দেয়াই রীতি)। পুজো উদ্যোক্তারা কোনোভাবে জানতে পেরে যান। এবং ওই শিশুটিকে কবর থেকে তুলে আনেন।
ধর্মে বা ধর্মবিশ্বাসে তো কখনোই কোনো ব্যাঘাত বা আঘাত করা যাবে না! শুধু ভাবি‚ সেই সন্তানহারা মায়েরা যখন প্রতিবছর শুনতে পান শোভাযাত্রার উল্লাস আর ঢাকের দ্রিমি-দ্রিমি আওয়াজ‚ তখন তাদের মানসিক স্থিতি কতোটা বজায় থাকে?
মন্তব্য চালু নেই