শিবির নেতা থেকে জঙ্গি নেতা মারজান
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার অন্যতম নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত নুরুল ইসলাম মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সক্রিয় নেতা ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কেবল মারজান নয়, নানা সময় সন্দেহভাজন বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত একাধিক তরুণেরই শিবির সম্পৃক্ততা ছিল।
গত আগস্টে পুলিশ মারজানের পরিচয় প্রকাশ করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানায়, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে আরবি বিভাগের ভর্তির পর থেকেই মারজান শিবিরের রাজনীতিতে জড়ান। এক পর্যায়ে শিবিরের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক স্তর সাথীতে পৌঁছে যান তিনি। এই শিক্ষার্থী ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রাখেন। এরপর আর ভর্তি হননি তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় এখানকার তালিকাভুক্ত শিবির নেতা ছিলেন। সে ছিল ধুরন্ধর প্রকৃতির। তার সম্পর্কে খোঁজ পেয়ে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও ধরতে পারেনি পুলিশ। আমরা যাওয়ার আগেই সব সময় সে সটকে পড়ে।’
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে মারজানের পরিচয় পায় পুলিশ। গত আগস্টে ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউটিনের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, এই হামলার অন্যতম নাটের গুরু ছিলেন মারজান নামে একজন। সেদিন এই মারজানের কেবল ডাকনামটি জানাতে পারেন মনিরুল। আর একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়। এরপর তার তার বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ পায়।
গত বছরের ১১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর রব হলে অভিযান চালিয়ে শিবিরের ১৫ জন নেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করে পুলিশ। এই নথিতে শিবিরের সাথী পর্যায়ের নামের তালিকায় আরবি বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র পরিচয়ে নুরুল ইসলাম নামের একজন ছিল। এই নুরুল ইসলামই যে মারজান সে বিষয়ে নিশ্চিত হয় পুলিশ। কারণ ওই শিক্ষাবর্ষে নুরুল ইসলাম নামে আরবি বিভাগের আর কোনো শিক্ষার্থী নেই।
তবে এতগুলো প্রমাণ থাকার পরও শিবির গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে মারজানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে সে সময়। সংগঠনটির দাবি, নুরুল ইসলাম মারজান নামে তাদের কোনো কর্মী কখনও ছিল না।
পুলিশ জানায়, মারজানের গ্রামের বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামে। তার বাবা হোসিয়ারি শ্রমিক নিজাম উদ্দিন। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর মারজান পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরপর পাবনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাসের পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর মারজান বিয়ে করেন শায়েলা আফরিন প্রিয়তীকে। পুলিশ জানিয়েছে, স্ত্রীকেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আটক হন তিনি।
জঙ্গি তৎপরতায় শিবির কর্মীরা
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত অভিযোগে এখন পর্যন্ত যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই এক সময় শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন অথবা এখনও জড়িত। এ কারণেই জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলছে সরকার।
গত ২৬ জুলাই মিরপুরের কল্যাণপুর জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহতদের মধ্যে নোয়াখালীর পশ্চিম মাইজদীর যোবায়েরুল ইসলাম শিবিরের কর্মী ছিলেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তার বাবা আবদুল কাইয়ুম। ছেলের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জড়িত না। কিন্তু চাচাতো ভাই বাহাদুর আমার ছেলেটিকে শিবিরে ঢুকিয়েছে, তার জন্যই আজ এই পরিণতি হলো।’ এই বাহাদুরকে এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একই অভিযানে জীবিত ধরা পড়া বগুড়ার রাকিবুল হাসান রিগানও শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টার রেটিনায় ভর্তির পর জঙ্গি তৎপরতায় জড়ান বলে জানিয়েছেন তার মা রোকেয়া আকতার। হাসান সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে কেবল দুই বিষয়ে পাস করেন। এই ধরনের একজন ছাত্রের মেডিকেলে ভর্তির জন্য কোচিং করা সন্দেহজনক-বলেছেন খোদ তার কলেজের অধ্যক্ষ এজাজুল হক।
২০১৬ সালের জুনে মাদারীপুরে এক কলেজ শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার সময় জনতার হাতে আটকের পর পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমও ছাত্র শিবিরের কর্মী ছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন।
গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামে উগ্রবাদী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য সন্দেহে আটক তিন কর্মীর একজন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সক্রিয় নেতা বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার নাম রনি।
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে হামলা পরিকল্পনার অভিযোগে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো ফেনীর পেয়ার আহমদ আকাশও শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র থেকে খোয়া যাওয়া এ কে ফোরটি সেভেন রাইফেল বিক্রির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। তখন তার ভগ্নিপতি ফেনী জামায়াতের নায়েবে আমির আবু ইউসুফের তদবিরে তিনি জামিন পান। এরপর মালয়েশিয়া পালিয়ে যান।ঢাকা টাইমসের সৌজন্যে।
মন্তব্য চালু নেই