শাকিরা : এক রেষ্টুরেন্ট ওয়েটারের জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প…

শাকিরার বাবা গল্প আর কবিতা লিখতেন। বাবার লেখা কবিতা ও গল্প পড়ে মুগ্ধ হতো শাকিরা। নিজেও থেমে থাকেননি। বাবার দেখাদেখি ছয় বছর বয়সেই কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দেন বাবাকে। তারপর একে একে বেশকিছু কবিতা লিখেন শাকিরা। পরে সেগুলো গান হিসেবে বিভিন্ন অ্যালবামে ব্যবহার করা হয়। কবি বাবার প্রেরণাতেই শাকিরার মাথায় গানের পোকা ঢুকে। সেদিনের সেই শাকিরা এখন জগৎবিখ্যাত। তার সুরের মোহনীয় জাদু ও কোমর দুলানো নাচে পুরো বিশ্ব কুপোকাত। সম্মান, যশ, খ্যাতি সবকিছুই এখন তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। অথচ এই শাকিরাকেই কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আজকের এই অবস্থানে আসতে হয়েছে। আসুন সে বিষয়ে কিছুটা জেনে নিই।

জন্ম:

১৯৭৭ সালের ২ ফ্রেব্রুয়ারী কলম্বিয়ার বারানকুলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন শাকিরা৷ তার পুরো নাম শাকিরা ইসাবেল মেবারাক রিপোল।

amazing-life-history-of-shakira-pic11

শৈশবের টানাপোড়েন ও শিল্পী হয়ে ওঠা:

শাকিরার জন্মটা মোটামোটি বিত্তশালী পরিবারেই হয়। জীবনের প্রথম দিকটা সুখে-শান্তিতেই কাটে তার। কিন্তু হঠাৎই তার অর্থবিত্তের জীবনে নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। তখন শাকিরার বয়স সবে আট বছর। হঠাৎই একদিন তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ব্যবসায় ধস নামলে শাকিরার বাবা অর্থাভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন আর মেয়েকে জোর করে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর শাকিরা নিজ শহরে ফিরে এসে দেখেন তাঁদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

amazing-life-history-of-shakira-pic2

শাকিরার গান-নাচ সব থেমে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু বড় হয়ে যিনি বিশ্ব মাতাবেন, তাঁর তো থেমে যাওয়া সাজে না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের আত্মবিশ্বাস অটুট রেখে সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। গানের টানে শাকিরা নিজ শহর বারানকুলা থেকে চলে যায় রাজধানী শহর বোগোটায়। সেখানে সে একা। শুরুতে নিজের খরচ চালানোর জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। বার, রেস্টুরেন্টসহ বেশকিছু জায়গায় পার্টটাইম কাজ করেছে। পাশাপাশি ঘরে, বন্ধুদের মধ্যে অব্যাহত রেখেছে গানের চর্চা।

amazing-life-history-of-shakira-pic18

আগেই বলেছি ছোটবেলাতেই বাবার কাছে থেকে কবিতা ও গানের হাতেখড়ি শাকিরার। চার বছর বয়সে তার প্রথম লেখা কবিতার নাম দেন ‘লা রোসা দো ক্রিস্টাল (বাংলায় ‘স্ফটিকের গোলাপ’)’। বাবাকে টাইপরাইটারে প্রায়ই গল্প লিখতে দেখে তাঁর নিজের একটা টাইপরাইটারের খুব শখ জাগে। বড়দিনের উপহার হিসেবে তাই জামা-জুতোর বদলে একটি টাইপরাইটার চেয়ে বসেন ছোট্ট শাকিরা। অবশেষে সাত বছর বয়সে হাতে আসে স্বপ্নের উপহার, তখনই কবিতা আর গান লিখে হাত পাকানোর শুরু।

amazing-life-history-of-shakira-pic17

ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে আরবীয় সুর ও ঐতিহ্যবাহী এক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সুরটি ছোট্ট শাকিরার এত ভালো লাগে যে উচ্ছ্বসিত হয়ে টেবিলের ওপর উঠে নাচতে থাকেন তিনি। বাবাকে কালো চশমা পরে থাকতে দেখে আট বছর বয়সে শাকিরা ‘তোমার কালো চশমা’ নামে তাঁর প্রথম গান লিখে ফেলেন।

amazing-life-history-of-shakira-pic9

এভাবে শৈশবেই সংগীতের ভুবনে পথচলা শুরু পৃথিবীজুড়ে সংগীতপিপাসু কোটি ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া গায়িকা শাকিরার। ইউটিউবে শাকিরার ছোট্টবেলার একটি ভিডিও রয়েছে। ভিডিও টাইম স্ট্যাম্প অনুযায়ী জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দৃশ্যটি ধারণ করা হয়, তখন এই তারকা ছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সের। ভিডিওটিতে দেখা যায় দর্শক সারির সামনে দিয়ে হেটে ষ্টেজে উঠছেন ‘হিপ্স ডোন্ট লাই’খ্যাত ১২ বছরের শাকিরা।

amazing-life-history-of-shakira-pic13

এই সময় ছোট শাকিরা গোলাপি শার্ট-সাদা প্যান্ট এবং মাথায় একটি টুপি পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। শাকিরা তার পারফর্মেন্স শুরু করার পূর্বে স্প্যানিশ ভাষায় বলেন, প্রথমেই আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেসব সমাজ সেবকদের প্রতি যারা কলম্বিয়ার জনগণদের সাহায্য করেছেন। আর এমন একটি অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতি দেওয়ার কারণে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

amazing-life-history-of-shakira-pic20

ক্যারিয়ার:

শাকিরার প্রথম দুটি এ্যালবাম ফ্লপ করে৷ তখন কলম্বিয়ার বাইরে কেউ শাকিরাকে চেনেন না৷ ১৯৯৫ সালে তাঁর এ্যালবাম ‘পিয়েস ডেসকালোস‘ খ্যাতি নিয়ে আসে কলম্বিয়ায়৷ এরপর ১৯৯৮ সালে আরেকটি এ্যালবাম তাঁকে জনপ্রিয় করে দক্ষিণ আমেরিকায়৷ এরপর ২০০১ সালে তাঁর মিউজিক ভিডিও ‘হোয়েন এভার হোয়্যার এভার’ জনপ্রিয়তা পায় গোটা বিশ্বে৷ বিশেষ করে শাকিরা সবাইকে নাচের যাদু দেখিয়ে মাত করে দেন৷ এরপরের এ্যালবাম লন্ড্রী সার্ভিস৷ সে এ্যালবামের জনপ্রিয় গান আন্ডারনিথ ইওর ক্লোথস৷ শাকিরা দু বার গ্র্যামি এওয়ার্ডস জিতেছেন, সাতবার ল্যাটিন গ্র্যামি এওয়ার্ডস এবং একবার গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন৷ কলম্বিয়ায় অন্য কোন গায়িকার গান এত বিক্রি হয়নি যতটা হয়েছে শাকিরার৷ সারা দক্ষিণ আমেরিকায় শাকিরা হলেন দ্বিতীয় গায়িকা যার ৫০ মিলিয়নেরও বেশি এ্যালবাম বিশ্ব জুড়ে বিক্রি হয়েছে৷ আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার বিলবোর্ড চার্টগুলোতে অন্য কোন দক্ষিণ আমেরিকার গায়িকা শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পারেনি একমাত্র শাকিরা ছাড়া৷ ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল৷ শেষ দিন অর্থাৎ ফাইনাল খেলার দিন খেলা শুরুর ঠিক আগে শাকিরা ভিক্লিফ জনের সঙ্গে হিপ্স ডোন্ট লাই গানটি লাইভ পারফর্ম করেন৷

amazing-life-history-of-shakira-pic8

বিশ্বকাপ মাতোয়ারা দর্শক কিছু সময়ের জন্য মাতোয়ারা হন শাকিরার নাচে-গানে৷ ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’র মাধ্যমেও পুরো বিশ্ব মাত করেন শাকিরা। তাঁর গাওয়া ২০১০ বিশ্বকাপের অফিশিয়াল থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’ ছিল ইউটিউবে সর্বাধিক শোনা গানের অন্যতম। ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপেও এর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে শাকিরা ‘লা লা’ গান দিয়ে মাতালেন পুরো বিশ্বকে। ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই এখন শাকিরা। শাকিরা অনর্গল কথা বলতে পারেন ইংরেজী, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ এবং ইতালিয়ান ভাষায়৷

amazing-life-history-of-shakira-pic5

প্রেম-ভালোবাসা:

শাকিরার প্রথম প্রেমিকের নাম অ্যান্টোনিও। অ্যান্টোনিও ছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো ডে লা রুয়ার ছেলে। শাকিরা ও অ্যান্টোনিও দীর্ঘ ১১ বছর একসঙ্গে বাস করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের প্রেম টেকেনি। বিচ্ছেদের পরই শাকিরার বিরুদ্ধে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের মামলা করেছিলেন অ্যান্টোনিও। আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে অ্যান্টোনিও উল্লেখ করেন, শাকিরা নামটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। এর পুরো কৃতিত্ব নিজের বলেই তিনি মনে করেন।

amazing-life-history-of-shakira-pic10

এছাড়া শাকিরার তুমুল জনপ্রিয় ‘হিপস ডোন্ট লাই’ ও ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান দুটি তৈরির ভাবনাও প্রথম তার মাথায় এসেছিল। এসব কারণেই তিনি মনে করেন, শাকিরার আয়ের একটি অংশ তার প্রাপ্য। কিন্তু মামলাটি ধোপে টেকেনি। এরপর আরও ৩টি মামলা করেন তিনি। কোনো মামলায়ই তিনি সুবিধা করতে পারেননি। সবগুলো মামলার রায়ই শাকিরার পক্ষে যায়।

অ্যান্টোনিওর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর স্প্যানিশ ফুটবল তারকা জেরার্ড পিকেকে নতুন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন শাকিরা। জেরার্ড পিকের সাথে শাকিরার পরিচয়টাও গান ও ফুটবলের মাধ্যমেই। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে স্পেনের হয়ে অনুশীলনে শাকিরার সঙ্গে পিকের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পিকে ছিলেন দলীয় অনুশীলনে আর শাকিরা গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের অফিসিয়াল সঙ্গীত ‘ওয়াকা ওয়াকা’র রেকর্ডিংয়ে। তখন থেকেই তাদের শুরু। আর ঠিক তার এক বছর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেমের ঘোষণা দেন এ জুটি। তাদের দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ১০ বছর। জেরার্ড পিকে শাকিরার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। তারপরও কোনো বাধা মানেনি তাদের ভালোবাসা। এখন তাদের সংসারে রয়েছে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান।

amazing-life-history-of-shakira-pic7

ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামকে পিছনে ফেলে এখন বিশ্ব ক্রীড়া সেরা দম্পতি জুটি জেরার পিকে ও শাকিরা। বিশ্বখ্যাত ‘ফোর্বস’ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বের সেরা দম্পতি জুটির এক তালিকা। তাতেই সংযোজিত হয়েছে বার্সেলোনার স্টপার পিকে ও কলম্বিয়ার পপ তারকা শাকিরার নাম৷

গিনেস ওয়ার্ল্ডস-এ রেকর্ডস:

শাকিরা সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা সাইটে একটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন । তিনি ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যে কিনা ফেসবুকে ১০০ মিলিয়ন লাইক পেয়েছেন । তিনি ম্যারাকানা স্টেডিয়ামে দাঁড়ানো আছেন এমন একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন । ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার একটু আগের মুহূর্ত ছিল সেটা । ছবিটি ৪ দিনের মধ্যেই ৩.৫ মিলিয়ন লাইক পেয়ে গেছিল, এটাই এই তারকার সবচেয়ে বেশী লাইক পাওয়া ছবি হয়ে গেছিল তখনই ।

নিজের নামে খেলনা:

নিজের নামে খেলনা বের করছেন শাকিরা। এ জন্য তিনি হাত মিলিয়েছেন খেলনা পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ফিশার-প্রাইসের সঙ্গে। তাদের শিশুদের উপযোগী ফার্স্ট স্টেপস পণ্যের আওতাভুক্ত হবে এসব। শাকিরার বানানো ৬ রকমের খেলনার মধ্যে থাকছে সুরেলা বাউন্সার, বর্ণমালা ব্লক ও সুরেলা ফুটবল। এগুলো বিক্রি থেকে প্রাপ্ত পুরো লভ্যাংশ দেওয়া হবে ৩৭ বছর বয়সি এই তারকার বেয়ার ফুট ফাউন্ডেশনে। কলম্বিয়ার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে ব্যয় করা হবে এসব অর্থ।

মানবদরদী:

শাকিরার একটি অলাভজনক ফাউন্ডেশন রয়েছে। নিজের জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘পিয়েস ডেসক্যালজোস’-এর নামে ১৯৯৭ সালে শাকিরা তার ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন নিজ দেশে। সার্বজনীন শিক্ষার প্রচারই এর মূল উদ্দেশ্য। যার অর্থায়নে তিনি মানব সেবার কাজ করে থাকেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি আটটি বিদ্যালয় গড়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন চ্যারিটেবল কনসার্টে তিনি অংশগ্রহণ করেন, তার বিভিন্ন অ্যালবাম ও গান থেকে অর্জিত কিছু অর্থ তিনি এই ফাউন্ডেশনে দান করেন। এ ছাড়া তিনি যুক্ত আছেন ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে।

বাংলাদেশে শাকিরা:

২০০৩ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে শাকিরা ইউনিসেফের গুডউইল এম্বাসাডর হন৷ এর আগে এত অল্প বয়সে কেউ এই সম্মান পায়নি। ২০০৭ সালে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে গুডউইল এম্বাসাডর হয়ে শাকিরা যান বাংলাদেশে৷ ১৭ থেকে ১৯শে ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে ঘুর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন৷ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলেন, সময় কাটান৷ বাংলাদেশের পটুয়াখালীতে তিনি যান৷ সেখানে বাচ্চাদের লেখাপড়ার বিষয়ে ইউনিসেফের কর্মকান্ড নিয়ে কথা বলেন৷ বিশেষ করে যে সব বাচ্চা ইউনিসেফের স্কুলে পড়াশোনা করছে তাদের খোঁজ খবর নেন তিনি৷

শাকিরার বাংলাদেশে ধারণকৃত ভিডিও:



মন্তব্য চালু নেই