শক্তিশালী হয়ে উঠছেন শেখ হাসিনা

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করে ধীরে ধীরে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ‘সংবিধান রক্ষায়’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৫ দফায় উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে টেকসই হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ভিত।

এদিকে দেশের রাজনীতিতে ‘ঝড়-টর্নেডো’খ্যাত ‘হরতাল-অবরোধ’কে পাশ কাটিয়ে অনেকটাই সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। একইসঙ্গে ‘উস্কানি’বা ‘ষড়যন্ত্র’তকমাওয়ালা বিদেশী শক্তির চাপও কাটিয়ে স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বর্তমান সরকার।

নানা বিতর্ক, সংঘর্ষ, নিহত-আহতসহ সহিংসতার মাধ্যমে প্রথমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে ৫ দফায় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচন বর্জন ও আন্দোলনের মুখে জাতীয় নির্বাচন শেষে দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি এই সরকারের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট টানা ৯২ দিন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারকে হটাতে তারা ব্যর্থ হয়। এতে অনেকটা শক্তিশালী ভিত তৈরি হয় সরকারের। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে জয়ী এ সরকারের শুরুতে নানা অনিশ্চয়তা থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে শক্ত অবস্থান তৈরি হয়।

জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক একে নিজেদের সফলতা হিসেবেই দেখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভিন্নমত পোষণ করলেও নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলাকে সরকারের সফলতা হিসেবেই দেখছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনা, বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকর, ৫ মে রাত্রে হেফাজতে ইসলামের সৃষ্ট পরিস্থিতি ও সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সফলতা। এ সকল পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি সক্ষম হয়েছেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশী-বিদেশী সমর্থন আদায় করে বর্তমান সরকার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে নেতৃত্বের গুণেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, শুধু নেতৃত্ব বা সরকারের সফলতা নয়, একই সঙ্গে বিএনপির ভুল সিদ্ধান্তও এ সফলতার পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের রণকৌশলগত ভুল সম-সাময়িক জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এ সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক সহযোগিতা করেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, শেখ হাসিনার পেছনে বৃহৎ একটি শক্তি আছে। তাই শেখ হাসিনা এ সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। ওই শক্তি শিথিল হয়ে গেলে সফলতা-ব্যর্থতা বলা যাবে।

তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলন যখন যে রকম হওয়া প্রয়োজন ছিল তখন তারা অন্য কারো প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। ফলে সেরকম আন্দোলন হয়নি। তারা বিদেশী চাপে পড়ে যায়। এখন অনেকেই মনে করছেন বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

একই বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, এ কথা সত্য যে মহাজোট সরকারের সময় অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে। সে সকল ঘটনা মহাজোট সরকার ও তাদের অন্তর্ভুক্ত দল এবং নেতৃত্বের কারণেই মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। তবে বিএনপিরও অনেক ভুল ছিল, যার ফলে সরকার এ সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পেরেছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে। আমি মনে করি স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে যে যেই দলেরই হোক না কেন সবাই মিলে দেশ চালানো উচিৎ।

এ ছাড়া নবম সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতির মধ্যে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করাও শেখ হাসিনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জও দক্ষতার সঙ্গে তিনি মোকাবেলা করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের নিয়ে বহুবার বহুবিতর্ক দেখা দিয়েছে। চেয়ার ছাড়তে হয়েছে চারজনকে। এদের মধ্যে সর্বশেষ বিচারপতি নিজামুল হককে তথ্য পাচারের অপবাদ ও এর সত্যতার দায়ভার নিয়ে বিচারের রায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে বিদায় নিতে হয়েছে। এ সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে বিচারের রায় কার্যকরে সক্ষম হয়েছে সরকার।

অন্যদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ খুনির মধ্যে ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করাই সরকারের বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর খুনিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে রায় দেয় সুপ্রীম কোর্ট। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ৯ খুনির মধ্যে কারাবন্দী ৫ জন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা, আর্টিলারি মহিউদ্দিন ও ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।

মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। ক্ষমতায় এসেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয় সরকার। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া। পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয় গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।

বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে নতুন নতুন কর্মসূচি সরকারের মধ্যে এক ধরনের আপাত ভীতির সৃষ্টি করলেও মহাজোটের একটি অংশকে বিরোধী দল বানিয়ে অত্যন্ত সফলতার সাথে নির্বাচন সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করে। এর পেছনে অবশ্য অনেক প্রতিবন্ধকতাও ছিল, যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে শেখ হাসিনার প্রশাসন এগিয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের ভাষ্যমতে, তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল বছরের শুরুতে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ইস্যুতে জামায়াত-শিবিরের আান্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চের বিতর্কিত ইস্যুতে ধর্মীয় গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচি। এমনকি শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে দেশে বিদেশে অনেকটাই সমালোচিত হয় সরকার। এতে বিএনপিসহ অনেকের ধারণা তৈরি হয় যে সরকারের পতন অনিবার্য। এটাকে পুঁজি করে বিএনপিও ঘোষণা করতে শুরু করে সরকারের পতন অনিবার্য। এ নিয়ে একের পর এক সরকার পতনের ডেটলাইন দিতে শুরু করে বিএনপি। এমনকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বল নিজেদের কোর্টে নেওয়ারও চেষ্টায় থাকে তারা। কিন্তু সব কর্মসূচিই এক প্রকার ভেস্তে দেয় শেখ হাসিনার প্রশাসন।

এদিকে সকাল-বিকাল কথার পরিবর্তন করা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সিদ্ধান্তহীনতা, সংলাপের কথা বলে নির্বাচন পেছান নিয়ে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপে এক ধরনের চাপে পড়ে সরকার। তার ওপর তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপির লাগাতার হরতাল, অবরোধ, কাদের মোল্লার ফাঁসি ইস্যুতে জামায়াতের মারমুখী অবস্থান দমন করতে কিছুটা হিমশিম খেতে থাকে সরকার। বিভিন্ন ইস্যুতে কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। নিজেদের এলাকায় মার খেতে থাকে দলীয় সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রীরাও। বিরোধী দল দমন ও সরকারের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকে সরকার। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে দাতা দেশগুলোর মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠে। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজেদের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তফসিল ঘোষণা করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান রক্ষার কথা বলে ৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচন সফলভাবে করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনের আগে আলোচনার মাধ্যমে আবারও মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বললেও ব্যাপক দাপটের সঙ্গে সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপিরা বলছেন পাঁচ বছরের আগে এ দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে সমর্থন না পেলেও নির্বাচনের পরে বিদেশীদের সমর্থনও পরোক্ষভাবে আদায় করে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে দেশে। ২০৪১ সালের লক্ষ্য পূরণের অঙ্গীকার করে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নতুন সরকার। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

টানা ৩৪বছর আওয়ামীলীগ সভানেত্রী

১৯৮১ সাল থেকে অদ্যাবধি ৩৪ বছর ধরে টানা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের মতো বিশাল এই সংগঠনে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রধানমন্ত্রী : বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলে ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন শেখ হাসিনা। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সংসদ নেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে যান শেখ হাসিনা। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই