আতংকে দিন কাটাচ্ছে মানুষ ॥ মাসোয়ারা পাচ্ছেন নেতারা ও নানা প্রশাসন

লক্ষ্মীপুর, যেখানে ২২ বাহিনীর রাজত্ব

লক্ষ্মীপুরে আতংকে দিন কাটাচ্ছে মানুষ, মাসোয়ারা পাচ্ছেন নেতারা ও নানা প্রশাসন, লক্ষ্মীপুর জেলায় চলছে ২২ বাহিনীর রাজত্ব। জেলার চন্দ্রগঞ্জের লতিফপুর গ্রামে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে ককটেল হামলা ও গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। এতে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। এই হামলা চালায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সোলায়মান উদ্দিন জিসান নিয়ন্ত্রিত বাহিনী।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি শুক্রবার কুমিল্লায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জিসান নিহত হয়। একই দিনে সদর উপজেলার বশিকপুর বাজারে হামলা চালিয়ে প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয় শীর্ষ সন্ত্রাসী লাদেন মাসুম বিল্লাহ নিয়ন্ত্রিত বাহিনী। লক্ষ্মীপুরে দুটি প্রত্যন্ত গ্রামের সর্বসাম্প্রতিক দুটি চিত্র। বাস্তবে পুরো জেলার চিত্র আরো ভয়াবহ। যেখানে পুলিশ সদস্যরাও নিরাপদ নন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে জেলার কোথাও নারীরা সহসা বাইরে আসে না।

পথে-ঘাটে প্রকাশ্যে চলে সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অস্ত্রের মহড়া আর পুলিশের রামরাজত্ব। আওয়ামীলীগ আর বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া ২২ সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে রীতিমতো জিম্মি এই জনপদের ছয় লক্ষাধিক মানুষ। স্কুল-কলেজের হাজারো ছাত্রী ওদের ভয়ে এখন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়। জামায়াতের সাবেক ক্যাডার মাসুম বিল্লাহ ওরফে লাদেন মাসুম চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর স্থানীয় ৪০-৫০ জন বখাটেকে নিয়ে নিজের নামে গড়ে তোলেন বাহিনী।

প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের অহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, নারী অপহরণ, গুম ও ধর্ষণ এমন কোনো কাজ নেই, যা তার বাহিনীর সদস্য করে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ জানান, সন্ধ্যা হওয়ার আগে বশিকপুর আশপাশের এলাকার মানুষ লাদেন মাসুম বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কে থাকে। ওদের চাঁদাবাজি, হত্যাসহ নানা অপকর্মে মানুষ অতিষ্ঠ। পুলিশের সঙ্গে লাদেন মাসুমের সখ্য রয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের। বশিমকপুর, দিলশাদপুর, নন্দীগ্রামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জেহাদী। তার বাহিনীর নাম জেহাদী বাহিনী।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এই বাহিনীর ভয়ে সবসময় আতঙ্কে এলাকায় অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে জেহাদীর অনুগত সন্ত্রাসীরা। এসব এলাকায় একাধিক ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল রাতে কাসেম জেহাদী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা সদর উপজেলা যুবদলের সহসভাপতি নজরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া দত্তপাড়ায় মোসলেহ উদ্দিন মুন্না বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়। সম্প্রতি হানিফ মিয়াজির হাটে এই বাহিনীর সন্ত্রাসীরা প্রবাসী রুবেল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে।

২০১৪ সালের ২৭ মার্চ রাতে একই উপজেলার বশিকপুর গ্রামে যুবলীগ নেতা খোরশেদ আলমকে গুলি করে হত্যা করে মুন্না বাহিনী। সদর উপজেলার ভাংগা খাঁ ইউনিয়নে একক আধিপত্য রয়েছে পা-কাটা ফরহাদ বাহিনীর। ওরা জকসিন ও ভাংগা খাঁ ইউনিয়ন চষে বেড়াচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনায় সন্ত্রাসী শরীফের গুলিতে পা হারালেও তাতে ফরহাদের দাপট কমেনি। এক পায়ে ভর করেই সে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ত্রাসী শরীফকেও গলা কেটে হত্যা করেছে। এছাড়া আসাদুজ্জামান বাবুল বাহিনীর প্রধান বাবুল র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। বাবুল মারা যাওয়ার পর হাল ধরে মটবী এলাকার সৌরভ হোসেন রুবেল পাটওয়ারী। এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয় রুবেল বাহিনী। এর সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। বাহিনী প্রধান রুবেল তিনটি পিস্তল ও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়ে জেলে রয়েছে।

সাবেক দত্তপাড়া ইউনিয়নের আজিজ বাহিনীর প্রধান আজিজ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ায় এবার তার বাহিনীর হাল ধরেছে তার ছেলে বিপ্লব। এই বিপ্লব বাহিনীর সদস্য ৪৫-৫০ জন। বশিকপুর এলাকায় রয়েছে এক সময়ের বিএনপি নেতা ও আওয়ামীলীগ সদস্য যোগদানকারী ইব্রাহিম হোসেন রতন। ৩৫-৪০ সন্ত্রাসী সাঙাত সহযোগে তারও রতন বাহিনী নামে একটি বাহিনী রয়েছে। সদর উপজেলার ভাংগা খাঁ ইউনিয়নে রয়েছে শাহজাহান ওরফে বড় মিয়া বাহিনী। তার সদস্য সংখ্যা ৩৫-৪০ জন। পার্বতীনগরে বাসার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২০-২৫ জন। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। সদর উপজেলার দাসের হাটের মামুমন বাহিনী দাপট চালিয়ে যাচ্ছে ৩০-৩৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে। সদর উপজেলার হাজিরপাড়ায় রয়েছে নিজাম উদ্দিন মুন্না বাহিনী।

এই বাহিনীর প্রধান মুন্না অস্ত্রসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও বাহিনীর ৩০-৩৫ সদস্যের কেউ এখনো ধরা পড়েনি। এসব বাহিনীকে দমাতে পুলিশ ও বিজিবি সমন্বয় যৌথ বাহিনী সম্প্রতি অভিযান চালায়। আটক করা হয় পুলিশের তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন মামলার প্রায় পাঁচ শতাধিক আসামীকে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও মূল সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সাফল্য দেখাতে পারেনি পুলিশ। সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের সন্ত্রাসী আলমগীর হোসেন ওরফে মোটা মাথা, হোসেন আহমদ, আলাউদ্দিন, কামাল প্রত্যেকের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। তাদের বাহিনী চাঁদাবাজি, অত্যাচার, নির্যাতনে ওই ইউনিয়নের নুরখাঁ, নলডগী, ঝাউডগী, চরমটুয়া, হাজীগঞ্জ ও আহম্মদ মিয়ার বাজারসহ আশপাশ এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। তবে লক্ষ্মীপুর এতসব বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর দত্তপাড়ার বিএনপি ক্যাডার ইসমাইল মোল্লা বাহিনী। ইসমাইল তার প্রয়োজনে সন্ত্রাসী জন্ম দেন। তার হাত ধরে উঠে এসেছে একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী। এদের মধ্যে আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনোয়ার, নুর হোসেন, শামীম বাহিনীর প্রধান শামীম ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে। এছাড়া বটতলীর সন্ত্রাসী হুমায়ুন বাহিনীর প্রধান হুমায়ুন, নবী বাহিনীর প্রধান নবী, ছোট হাকিম বাহিনীর প্রধান হাকিম (বর্তমানে সৌদি প্রবাসী), বড় হাকিম বাহিনীর প্রধান বড় হাকিমসহ অসংখ্য বাহিনী জন্ম দিয়েছেন তিনি। মোল্লা বাহিনীর অন্যান্য সদস্য নাছির মোল্লা, কালা সহিদ, রিয়াজ, সাহাব উদ্দিন ও কিলার শাহজাহানের পরিচিতি রয়েছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে।

এছাড়া বসুরহাটে শাহাদাত বাহিনী, করপাড়া ইউনিয়নের মুরাদ বাহিনী, রামগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুমন মজুমদারের সুমন বাহিনী একই থানার পুলিশের তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসী আল আমিন পাটোয়ারী রকিব রকি বাহিনী লক্ষ্মীপুরকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছে।

স্থানীয় ও রাজনেতিক নেতাদের অভিযোগ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ শরিফুল ইসলাম লক্ষ্মীপুরের ভারপ্রাপ্ত এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জেলায় কমপক্ষে ২২টি অপরাধী গ্রুপের উত্থান হয়েছে। কারণ ওই পুলিশ কর্মকর্তা অপরাধীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিতেন। আর এ জন্য তার নাকের ডগায় অপরাধ সংঘটিত হলেও তিনি চুপ থাকতেন। অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শেখ শরিফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে কোন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এম আলাউদ্দিন বলেন, লক্ষ্মীপুরে বিএনপিসহ নামধারী বিভিন্ন বাহিনীর সন্ত্রাসীদের হাতে এ পর্যন্ত ২৫ জনেরও বেশি তাদের নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। মাদক, সন্ত্রাসে ছেয়ে গেছে লক্ষ্মীপুর। এ অবস্থায় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া জানান, জেলায় আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। আইন শৃঙ্খলার অবনতির কথা স্বীকার করে লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার শাহ মিজান শফিউর রহমান বলেন, পুলিশের ওপর এখনই আস্থা হারানো উচিত হবে না। অনেক সন্ত্রাসী ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভালো অচিরেই এ সংকট কাটবে।



মন্তব্য চালু নেই