রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে প্রস্তাবিত এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ : রয়টার্স
নারকিয় নির্যাতনে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের টেকনাফে ও আশপাশের এলাকায় বসবাস করছে। শরণার্থীদেরে এই এলাকা থেকে সরিয়ে সাময়িকভাবে পুনর্বাসনে বেছে নেওয়া হাতিয়ার ঠেঙ্গারচর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। জায়গাটি ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ। এ পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয় বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
শুক্রবার(৩ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সংস্থাটি এক সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় সেখানে দ্বিগুণ পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে থাকে। জনশূন্য এলাকাটি কর্দমাক্ত। এ ছাড়া জলদস্যুদের উৎপাত তো রয়েছেই। রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে ঠেঙ্গারচরে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনাকে বাস্তবসম্মত নয় বলে সমালোচনা করেছে সংবাদ সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জায়গাটি ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। তবে তারা ঠেঙ্গারচরে যেতেও ইচ্ছুক নয়। রয়টার্সের সাংবাদিকেরা একটি মাছ ধরার নৌকায় করে ঠেঙ্গারচরে পৌঁছে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন চীনের তৈরি মেশিন গানসহ বিভিন্ন অস্ত্রসজ্জিত কোস্টগার্ডের সাতজন কর্মকর্তা। জলদস্যুদের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত সন্দ্বীপ উপজেলার সবচেয়ে কাছাকাছি বসতি থেকে হাতিয়ার ঠেঙ্গারচর নৌপথে দুই ঘণ্টা দূরত্বে অবস্থিত। সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে ১১ বছর আগে জেগে ওঠে ঠেঙ্গারচর। সেখানে কোনো ঘর নেই, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক নেই, লোকজনও নেই। বর্ষা মৌসুমে জায়গাটি বেশির ভাগ সময় বন্যার পানিতে ভেসে যায়। যখন সাগর শান্ত থাকে, তখন জলদস্যুরা জেলেদের অপহরণের খোঁজে থাকে। ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে মুক্তি পায় ওই জেলেরা।
মানবিক সংকটের সাময়িক সমাধান হিসেবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে ঠেঙ্গারচরে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার। আগে থেকেই বাংলাদেশে নির্দিষ্ট শরণার্থীশিবিরে বসবাস করছে দুই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ বলে, এই শরণার্থীরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তা ছাড়া বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রেও তারা ঝুঁকিপূর্ণ।
এর আগে ২০১৫ সালে মানবশূন্য ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রথম প্রস্তাব ওঠে। সেই সময়ই তা মানবাধিকারকর্মীদের তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞরা এই প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে মন্তব্য করেন। তবে এই সপ্তাহে বাংলাদেশের মন্ত্রী রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গার চরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মন্ত্রীর নাম প্রকাশ না করে বলা হয়, তিনি (মন্ত্রী) জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ সেখানে আশ্রয় দেওয়াসহ জীবন ধারণে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে। যদিও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাঁরা এখন পর্যন্ত ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পায়নি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্থানীয় বাংলাদেশিদের দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ঠেঙ্গারচর থেকে সবচেয়ে কাছাকাছি এক গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪৮) বলেছেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে শুধু খারাপ কথাই শুনি। যদি তারা জলদস্যুদের সঙ্গে কাজ করে এবং অপরাধে জড়িত হয়, তাহলে আমরা তাদের এখানে চাই না। তবে যদি তারা ভালো মানুষ হয়ে থাকে, তবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সাহায্য করা উচিত।’ একই ধরনের অনুভূতি কাজ করতে দেখা গেছে গ্রামের অন্য বাসিন্দাদের মধ্যেও। তাদের মতে, রোহিঙ্গারাও মুসলিম, তারা সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে।
গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, আশপাশের জলে জলদস্যুরা ঘুরে বেড়ায়। তারা নৌকা ছিনিয়ে নেয়। মাছ নিয়ে যায়। জেলেদেরও ধরে নিয়ে যায়। ক্ষতিপূরণ পেলেই কেবল জেলেদের ছাড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ কামরুল হাসান বলেছেন, এই এলাকাগুলো ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা প্রবণ। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপগুলো বসবাসের জন্য ছিল বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সেখানে বর্ষা মৌসুমে দ্বিগুণ পরিমাণ বৃষ্টি হয়।
স্থানীয় একজন সাংবাদিকের বক্তব্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের সময়গুলোতে এই সব দ্বীপের লোকজনকে নিয়মিত উপকূলের কাছে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর মতে, এখানে পুনর্বাসনের পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত ছিল না। ওই সাংবাদিক আরও বলেন, এই এলাকায় এ রকম আরও দ্বীপ রয়েছে। সেগুলোর উন্নয়নে ৪০ বছর সময় লেগেছে। তাও এখন পর্যন্ত তা মৌলিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।
আবু সালাম নামে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর বক্তব্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা ঠেঙ্গারচরে যেতে চান না। মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের পর আবু সালাম গত ডিসেম্বরে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘মিয়ানমারে আমরা সব ফেলে চলে এসেছি। সেখানে আমাদের বাড়ি ছিল। একমাত্র নাগরিকত্ব পেলেই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক শতাব্দি ধরে বসবাস করছে মুসলিম রোহিঙ্গারা। শান্তির বাণি আওরানো বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মগরা নারকিয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর। এখনো মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়নি। গত কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন অজুহাতে মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদের উপর নগ্ন হামলা চালিয়ে আসছে। নির্যাতন সইতে না পেরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ক্যাম্পের বাইরে কত রোহিঙ্গা আছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই কোথাও।
নিরাপত্তা ইস্যুতে এই শরণার্থীদের এক এলাকায় রাখার কথা ভাবছে সরকার। এর আগেও একবার তা ভাবা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।
মন্তব্য চালু নেই