রায়হানের ভণ্ড প্রেম; রাইসার কালো রাত

অ্যাকাউন্টিং প্রথম বর্ষের ছাত্রী তিনি। মায়াবী চেহারা। কেবল কৈশরে পড়েছে। কিন্তু এ বয়সেই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন তার স্বাভাবিক জীবন।

পিতামাতার সঙ্গে রাজাবাজারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার পাশেই ছিল একটি মেস। আর এ মেসের বাসিন্দা রায়হানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় জানালা দিয়ে। পরে চলতে থাকে ইশারায় কথা। এরপর মোবাইল ফোন নম্বর বিনিময়।

রায়হান তখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোচিং করতে ঢাকায় এসেছিলেন। তাদের মাঝে ফোনে আলাপ হতে হতে একপর্যায়ে তারা গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এরপর রাইসা দেখা করতে যেত রায়হানের সঙ্গে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের প্রণয়।

পরে রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে চলে যান। তার পিতামাতা রাইসাকে মেনে নেবে না এ অজুহাতে রাইসার সঙ্গে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরের বছর আবারও রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য আসেন। তখন পুনরায় দেখা করেন রাইসার সঙ্গে। আবার শুরু হয় তাদের মেলামেশা। এর মাঝে রাইসার এইচএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে গেলে রাইসার পিতামাতা তাকে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। রাইসা একথা রায়হানকে জানানোর পর রায়হান তাকে ঢাকায় চলে আসতে বলেন। পরিবারের কাউকেই কিছু না জানিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বাড্ডায় কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের পর কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে তাই তারা নিজ নিজ বাড়ি চলে যান। এভাবেই তাদের দিন কাটছিল। রাইসার মামাতো বোনকে পড়ানোর সুবাদে রাইসাদের বাসায় রায়হানের অবাধ যাতায়াত ছিল।
একদিন রাইসার মামাতো বোনের জন্মদিনে রায়হান দাওয়াত পেয়ে তাদের বাসায় যান। এসময় রাইসাদের বাসায় যে পরিবার সাবলেট থাকতো তারা না থাকায় রায়হান সেই রুমে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যায় তখনই যখন রাইসার পিতা তাদের বাড়িতে রায়হানের রাত কাটানোর কথা জানতে পারেন। তিনি এটা নিয়ে রাগারাগি করলে রাইসা বাধ্য হয়ে তার পিতাকে তাদের বিয়ের কথা বলে দেন। এরপর রাইসার পিতা রাইসাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।

শুরু হয় রাইসার নতুন জীবন। তারা দুজনে মিলে সাবলেটে ৫০০০ টাকা দিয়ে একটি রুম ভাড়া নেন। সেখানে অল্প অল্প করে তাদের সংসারের জিনিস কিনতে থাকে। এভাবে ভালই কাটছিল তাদের। এরই মধ্যে রাইসার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। মানবিক বিভাগ থেকে রাইসা সিজিপিএ ৩.৯০ পান।

কিন্তু রাইসার যেহেতু শখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার তাই তার স্বামী তাকে উদ্বুদ্ধ করে পুনরায় পরীক্ষা দিতে। এ বিষয়ে সকল প্রকার সহযোগিতা পায় রাইসা তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্বামীর কাছ থেকে। এরপর ঘনিয়ে আসে রাইসার সেই পরীক্ষার দিনটি প্রথম পরীক্ষার দিন রাইসার স্বামী রাইসাকে নিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দিন কেন জানি আর যেতে চান না।

রাইসা সেদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে তার স্বামীর মোবাইল ফোনে একটি ক্ষুদেবার্তা দেখতে পান। যাতে লেখা ছিল- ‘ভোর ৫টায় আমায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ো।’ রাইসা এ বিষয়ে তার স্বামীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন তার এক বন্ধু তাকে বার্তাটি পাঠিয়েছে। রাইসা সরল মনে বিশ্বাস করেন তার স্বামীকে। এরপর পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফেরার পর রাইসা তার স্বামীর ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা দেখতে পান।

এভাবেই দিনটি পার হয় তাদের। পরে রাইসা তার স্বামীর মোবাইল ফোনে ঠিক একই ক্ষুদেবার্তা আবার দেখতে পান। এবার রাইসা আর তার স্বামীকে কোন প্রশ্ন করেন না। পরে তার স্বামী রায়হান রাইসার পরীক্ষা চলাকালে হঠাৎ একদিন বাসায় এসে কান্নাকাটি করতে থাকে। দেয়ালে অবিরাম মাথা ঠুকে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে- এ আমি কি করেছি। এরপর রাইসা তার স্বামীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতে থাকেন তার অপকর্মের কথা।

জানান রাইসার পরীক্ষা চলাকালে তার পুরানো বান্ধবী যিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যালে অধ্যয়নরত তাকে বাসায় নিয়ে এসে ফুর্তি করার কথা। এ কথায় রাইসা ব্যথিত হলেও তার স্বামীর অস্থিরতা দেখে মাফ করে দেন। উল্টো সান্ত্বনা দিতে থাকেন স্বামীকে। তারপর কিছুদিন ভালোই কাটে রাইসাদের। এরপর রায়হান একদিন জোর করে রাতের বেলা রাইসাকে তার বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

রাইসা সেখানে যাওয়ার পর রাইসাদের পাশের রুমে যে ভদ্রলোক ভাড়া থাকতেন তিনি রাইসাকে ফোন দিয়ে বলেন, তার স্বামী একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছে। একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাইসা বোনের বাড়ি থেকে চলে আসেন। দীর্ঘ ১০ মিনিট তাদের রুমের দরজা ধাক্কানোর পর তার স্বামী দরজা খুলে দিলে রাইসা সেদিন হাতেনাতে তার স্বামীকে ধরে ফেলেন।

রাইসাকে দেখামাত্রই তার বরের বান্ধবী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন। কারণ তিনি নিজেও অবগত ছিলেন না যে রায়হান বিবাহিত। সেই মেয়ের চিৎকার শুনে লোকলজ্জার ভয়ে রাইসা নীরবে সবকিছু হজম করেন। গভীর রাত হওয়ায় রাইসার বিবেকে বাধে ওই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলতে। রাইসার পক্ষেও সম্ভব নয় ওই রুমে থাকা। আর তাই তিনি পুনরায় তার বোনের বাড়িতে চলে যান। সেই রাতটিকেই রাইসা অখ্যায়িত করলেন তার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ রাত হিসেবে।

রাইসার ভাষায় একটা রাত যে কত বড় হয় ওইদিন আমি বুঝেছি। এ বিষয়টি রাইসা তার পিতামাতা কাউকে জানায় না। এর কিছুদিন পরই রাইসার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। রাইসা ৪.৮০ পেয়ে কৃতকার্য হন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভর্তি হন একটি কোচিং সেন্টারে।

এর মাঝে রায়হানের ভাই ঢাকায় রায়হানের সঙ্গে থাকতে আসে। তখন রায়হান রাইসাকে ছাত্রী হোস্টেলে উঠিয়ে দেয়। আর রায়হান ও তার ভাইসহ ৪ জন মিলে একটি রুম ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। রাইসা হোস্টেলে ওঠার পরপরই বদলে যেতে থাকে রায়হান। রাইসার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাইসার হোস্টেলের সবাই জেনে যায় তার আর রায়হানের বিরোধের কথা।

এত কিছুর পরও রাইসাকে তার স্বামীসহ মোট ৪ জনের জন্য প্রতিদিন রান্না করে দিতে হতো। এতে করে রাইসার পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে থাকে। যার জন্য এইচএসসিতে ভাল ফলাফল সত্ত্বেও রাইসা ব্যর্থ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে। এতে করে রাইসা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরে ভর্তি হন ইডেন কলেজে।

এভাবে হোস্টেলে থাকতে থাকতে একসময় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যান রাইসা। তিনি তখন রায়হানের ছোট ভাইকে সব খুলে বলেন। এরপর তারা একটা রুম ভাড়া করে একরুমে ৩ জন থাকতে শুরু করেন। এর মাঝে পেরিয়ে যায় ২টি বছর। রায়হানের পরিবারের অগোচরেই ঘটতে থাকে এসব কিছু।

এরপর রাইসা একসময় গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তার সন্তানের গর্ভে আগমনী বাণী শুনে অত্যন্ত রেগে যান রায়হান। এসময় তিনি রাইসাকে বারবার চাপ দিতে থাকেন গর্ভের সন্তান নষ্ট করে ফেলার জন্য। একসময় রাইসা পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য রাজি হলেও ডাক্তার তার শারীরিক অবস্থা দেখে কঠোরভাবে রাইসাকে নিষেধ করে দেন।

এ ঘটনায় রায়হান রেগে গিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। অসহায় রাইসার তখন আশ্রয় মেলে তার মায়ের বাড়িতে। এর মাঝে রাইসা রায়হানকে ফোন দিলে তিনি শুধু একটি কথাই বলতেন ওই সন্তানের পিতা আমি না। একথায় অত্যন্ত ভয় পেয়ে যান রাইসা। পরে চরম প্রতিকূলতার মাঝে রাইসা একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।

এ খবরেও রায়হানের কোন ভাবান্তর হয় না। রাইসা অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার স্বামীর ঠিকানা পেয়ে সেখানে গেলে রাইসাকে তার স্বামী অপমান করে তাড়িয়ে দেন। বলেন, আমি এই মেয়েকে চিনি না। এই মেয়ে আমাকে গুণ্ডা দিয়ে অপহরণ করে বিয়ে করেছে। এ বাচ্চাও আমার না। এভাবে রায়হান রাইসাকে বের করে দেন।

বর্তমানে রাইসা ও তার পরিবারের নামে একাধিক থানায় মামলা চলছে। হুমকি দেয়া হয়েছে রাইসার ছোট ভাইটিকেও মেরে ফেলার। আর তাই ছোট শিশুটিকে নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্ক আর হতাশার মাঝে দিন কাটছে রাইসার। -মানবজমিন।



মন্তব্য চালু নেই