‘রাষ্ট্রপতি সবার শ্রদ্ধেয়, তাকে কেন টানেন?’

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশে ৮ মে পর্যন্ত সময় পেল সরকার। বার বার সময় চেয়ে আবেদনে বিরক্তি প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সময় দিলাম। কিন্তু আমরা মনে করি, এরপর আর কোন অজুহাত থাকবে না।

অ্যাটর্নি জেনারেলের দুই সপ্তাহের সময় চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ৮ মে পরবর্তি শুনানির দিন ধার্য করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘সময় আবেদনের এই বিষয়টি এলে আপনি মাথা নিচু করে থাকেন। রাষ্ট্রপতির বিষয় টানেন। রাষ্ট্রপতি সবার শ্রদ্ধেয়, তাকে কেন টানেন? তার (রাষ্ট্রপতির) দোহাই যখন দেন তখন আমাদের কষ্ট লাগে। রাষ্ট্রপতি খুব ভালো লোক।’

এর আগে গত ২৮ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেলের চার সপ্তাহের সময় চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বেঞ্চ এক সপ্তাহের সময় মঞ্জুর করেছিলেন। ওইদিন সময় আবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, আইন মন্ত্রণালয় আসা করছে বিধিমালার বিষয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপতি পদক্ষেপ নেবেন।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।

সে ধারাবাহিকতায় আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর ২০১৫ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় শৃঙ্খলা সংক্রান্ত একটি খসড়া বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিমকোর্টে পাঠায়। কিন্তু গত বছরের ২৮ আগস্ট আপিল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ, যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী।

এরপর সুপ্রিমকোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইনমন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একইসঙ্গে ৬ নভেম্বরের মধ্যে তা প্রণয়ন করে প্রতিবেদন আকারে আদালতকে জানাতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়।

গত ৬ নভেম্বর সে অনুসারে মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানাতে না পারায় আপিল বিভাগ বিধিমালা চূড়ান্তের বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়ে ৭ নভেম্বর এ বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য করেন।

কিন্তু ৭ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল সময়ের আবেদন জমা দেন, যাতে বিধিমালাটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কথা উল্লেখ করেন তিনি। তখন সর্বোচ্চ আদালত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত তাকে সময় দেন।

পরে ২৪ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল গেজেট প্রকাশে আরও এক সপ্তাহ সময় চাইলে আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পর গত ১ ডিসেম্বর পুনরায় এক সপ্তাহ সময় চাইলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন।

কিন্তু ৮ ডিসেম্বর বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে ১২ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে মৌখিক নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আট বিচারপতির বেঞ্চ।

তবে সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং মোহাম্মদ শহিদুল হকের হাজির হওয়ার একদিন আগেই নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।

রাষ্ট্রপতির দেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়টি ১২ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে জানিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে এ বিষয়ে ভুল বোঝানো হয়েছে’ উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বিধিমালার গেজেট আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেন। এসময় আদালতে হাজির ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং মোহাম্মদ শহিদুল হক।

কিন্তু গত ১৫ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল আবার সময়ের আবেদন করেন। সেসময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিধিমালার গেজেট আদালতে দাখিলের জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন আপিল বেঞ্চ।

এক সপ্তাহ পর গত ১২ ফেব্রুয়ারি আচরণবিধির গেজেট করতে কেন সময় দরকার, তার কারণ ১৩ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে জানাতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিল আপিল বিভাগ।

এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান বিধিমালাটি বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। পরে তিনি ২ সপ্তাহ সময় আবেদন করলে আপিল বেঞ্চ বিধিমালার গেজেট প্রকাশের জন্য ২ সপ্তাহ সময় দেন।

এর দুই সপ্তাহ পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেলের আবার দুই সপ্তাহ সময় আবেদন মঞ্জুর করেলে আদালত ১৪ মার্চ শুনানির দিন ধার্য করেন।

এরপর ১৪ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেলের করা চার সপ্তাহ সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বেঞ্চ দুই সপ্তাহ সময় আবেদন মঞ্জুর করেন।

ওইদিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে। মনে রাখবেন রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বড়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফেয়ার-প্লে হচ্ছে না। এভাবে আর কতো’?



মন্তব্য চালু নেই