রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল চায় ইউনেসকো
সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্য বাংলাদেশের কাছে সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে তাতে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে উল্লেখ করে প্রকল্পটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
গত মার্চে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ইউনেসকোর তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল সরকারকে দেওয়া প্রতিবেদনে এই অনুরোধ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, এখনই সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় তারা অন্তর্ভুক্ত করবে না। তবে রামপাল প্রকল্প বাতিলসহ ইউনেসকোর সুপারিশ মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ২০১৭ সালের বিশ্ব ঐতিহ্য কমিশনের সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তারা জানিয়েছে।
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদন (ইআইএ), প্রকল্পের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানির বক্তব্য এবং দরপত্রের নথির মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি পাওয়া গেছে। প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশ সফরের সময় সীমিতসংখ্যক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা কোম্পানির লোকেরা সংগঠিত করেছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘ইউনেসকোর প্রতিবেদনে শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে নয়, সুন্দরবন বিষয়ে আরও অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব পরামর্শ মানা বাস্তবসম্মত কি না, তা ভেবে দেখার ব্যাপার আছে। তবে ইউনেসকো যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তার উত্তর আমরা দেব। তারপরও তারা যদি একই সুপারিশ করে, তখন তা ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে আপাতত রামপালের কাজ বন্ধ হচ্ছে না।’
তবে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমরা এত দিন ধরে রামপাল নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ে আসছি, তা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিসম্মত তা ইউনেসকোর প্রতিবেদনে প্রমাণিত হলো। সরকার কীভাবে ইউনেসকোর প্রতিবেদনের জবাব দেবে, তার উপায় না খুঁজে বরং কীভাবে এবং কত দ্রুত প্রকল্পটি বাতিল করা যাবে, সেই উপায় বের করে দ্রুত তা সম্পাদন করা উচিত।’
রামপাল প্রকল্প বাতিল করার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ইউনেসকো চারটি ঝুঁকির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। ঝুঁকিগুলো হচ্ছে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, জাহাজ চলাচল বেড়ে যাওয়া এবং প্রকল্প এলাকায় শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো নির্মিত হলে পুঞ্জীভূত দূষণ।
এ ছাড়া রামপালের জন্য যে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে হয়নি মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে বাজারে সহজলভ্য ও সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তি আনা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানও বজায় রাখা হচ্ছে না।
রামপালে নির্মিতব্য ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা থেকে ৬৫ কিলোমিটার ও মূল সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিদ্যুৎ প্রকল্পের কয়লার ছাই বাতাসে মিশে সুন্দরবনে দূষণ ঘটাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ছাইসহ দূষিত পানি বনের নদীতে পড়েও দূষণ ঘটাবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত এ বিষয়ে বলেন, রামপাল প্রকল্পের ইআইএ (পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা) প্রতিবেদনে সুন্দরবনের যেসব ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে, তা উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি সুন্দরবনের ক্ষতি আদৌ কমাতে পারবে কি না, আর এসব প্রযুক্তি দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর থাকবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বন্য প্রাণীর বিপদ
প্রতিবেদনে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণগুলো উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্য বিশ্বে অনন্য ও অসাধারণ। এখানে একই সঙ্গে মিষ্টি ও লোনা পানির মিশ্রণে ব্যতিক্রমী এক প্রাণসম্পদের আধার তৈরি হয়েছে। বিশ্বের মহাবিপন্ন প্রাণী বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা এই বনেই সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও বিপন্নপ্রায় দুটি ডলফিনের প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন এবং বাটাগুড় বাস্কা কচ্ছপ এখনো সুন্দরবনেই টিকে আছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত দেড় শ বছরে সুন্দরবনের আয়তন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। এই বন থেকে লোনা পানি এলাকার হরিণ, বুনো মহিষ, জাভান জলহস্তী, হগ হরিণ, বনগরু ও মাগার কুমির বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ইউনেসকো এই প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মার্চে আসতে বলা হয়। এক সপ্তাহ অবস্থান করে প্রতিনিধিদলটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা, খুলনা, বাগেরহাট পরিদর্শন করে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিন সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ দলটি। দলটিতে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) বিশেষজ্ঞ নাওমি ডোক ও মিযুকি মুরাই এবং ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ফ্যানি ডোভার।
ইউনেসকো ২০১৪ সালের বার্ষিক অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রথম উদ্বেগ জানায় এবং বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে দুটি চিঠি দেয়। প্রকল্পের কারণে কী ধরনের ক্ষতি হবে, তা নির্ণয়ের জন্য তারা বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে। নিয়ম অনুযায়ী সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়। কারণ, সুন্দরবনের জন্য বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান ধরে রাখতে হলে ইউনেসকোর সুপারিশ মানতে হবে। না মানলে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ পড়তে পারে।
গত জুনে ইউনেসকো প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে তাদের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেয়। এরপর আগস্টে সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এখন প্রতিবেদনটির জবাব দেওয়ার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, কৃষি, নৌপরিবহন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১ ডিসেম্বরের মধ্যে জবাব দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনেসকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের মূল সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার, সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা থেকে ৪ কিলোমিটার ও বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হচ্ছে। সাউথ এশিয়ান হিউম্যান রাইটস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে ইউনেসকো বলছে, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
অসম্পূর্ণ ইআইএ
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে রামপাল প্রকল্পের ইআইএকে অসম্পূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এটি তৈরি করার ক্ষেত্রে সব পক্ষের মতামত সঠিকভাবে নেওয়া হয়নি, অর্থাৎ সীমিত কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, যা ইআইএ করার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির ওপর প্রভাবের বিষয়টি ওই সমীক্ষায় উঠে আসেনি। বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের মতামতও নেওয়া হয়নি।
ইউনেসকো রামপাল প্রকল্পের সব নথি ও প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের (বিএইচইএল) কাছ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য তারা পায়নি। বাস্তবে কোন ধরনের যন্ত্র স্থাপন করা হবে এবং কীভাবে করা হবে, ইআইএ প্রতিবেদনে তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রযুক্তি ও যন্ত্র স্থাপন হবে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য ইউনেসকো পায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
ইউনেসকোর কাছে যতটুকু তথ্য, প্রতিবেদন ও নথি এসেছে, তার ভিত্তিতেই তারা রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ওপর চার ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে। যা সুন্দরবনের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি করবে, তা হচ্ছে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শিল্পের পুঞ্জীভূত দূষণ, জাহাজ চলাচল ও নদী খননের প্রভাব।
সুন্দরবনে অ্যাসিড বৃষ্টি হবে
কয়লা পোড়ানোর কারণে রামপাল প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণে সালফার ডাই-অক্সাইড (এসও-২), কার্বন ডাই-অক্সাইড (সিও-২), নাইট্রাস অক্সাইড (এনও-২) ও মারকারি নির্গত হবে। সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড মেঘের সঙ্গে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটাবে।
অ্যাসিড বৃষ্টি সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে হুমকিতে ফেলবে। এতে সুন্দরবনের নদীর পানিতে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম প্রবেশ করাবে, যা সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি ও বণ্য প্রাণীদের মৃত্যুর কারণ হবে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বছরে ১০ লাখ টন কয়লার ছাই তৈরি করবে। এসব ছাইয়ের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক যেমন আর্সেনিক, লেড, মার্কারি, নিকেল, ভ্যালাডিয়াম, বেরিলিয়াম, বেরিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম ও রেডিয়াম থাকবে।
পারদ ঢুকে পড়তে পারে খাদ্যচক্রে
মারকারি বা পারদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব পারদ সুন্দরবনের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলবে। এখানকার পানিতে মিশে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে পড়বে, যা খাদ্য হিসেবে মানুষের শরীরে গিয়ে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও উন্নতি স্তিমিত করে দেবে।
ইউনেসকো পারদের দূষণ নিয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, রামপাল প্রকল্পে পারদ নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যথেষ্ট ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। এ ছাড়া পারদের দূষণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন প্রযুক্তিও এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে তৈরি হয়নি।
রামপাল প্রকল্পে ব্যবহৃত আলট্রা সুপার প্রযুক্তি ইতিমধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও ভারতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সুন্দরবনের মতো বিশ্ব ঐতিহ্য ও অসাধারণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকার পাশে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা এখন পর্যন্ত বিশ্বে নেই।
বায়ুদূষণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ দলকে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, রামপাল প্রকল্পের ধোঁয়ার প্রভাব সীমিত রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সাধারণত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনির উচ্চতা ৫০০ ফুট হয়ে থাকে। কিন্তু রামপাল প্রকল্পের চিমনির উচ্চতা হবে ৯০০ ফুট।
ওই চিমনি দিয়ে সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত হবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিমনির উচ্চতা বেশি হওয়ায় তা স্থানীয় পর্যায়ে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূষণ কমাবে না, বরং উঁচু চিমনির কারণে দূষিত বায়ু ওজোনস্তরে চলে যাবে, যা সামগ্রিকভাবে সুন্দরবন এলাকায় বায়ুদূষণ ছড়িয়ে দেবে।
সাধারণত জানুয়ারি ও মার্চে বাংলাদেশের বায়ুপ্রবাহ উত্তর থেকে উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। ওই সময়ে রামপাল প্রকল্প থেকে নির্গত হওয়া বায়ু ৬৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য অংশের আকাশসীমায় ছড়িয়ে পড়বে। ফলে উঁচু চুল্লি বিশ্ব ঐতিহ্য অংশের আরও বেশি ক্ষতি করতে পারে।
পানিদূষণ
বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা যন্ত্রপাতির তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার কিউবিক মিটার পানি পশুর নদী থেকে উত্তোলন করবে। কিন্তু এই হিসাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যান্য অবকাঠামো ও কাজে ব্যবহৃত পানির হিসাবকে আমলে নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের পর দূষিত পানি সুন্দরবনের নদীতে ছাড়া হবে, যা সুন্দরবনের মধ্যে মিশে গিয়ে দূষণ বাড়াবে।
পুঞ্জীভূত দূষণ
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সেখানে একটি শহর ও প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আশপাশে নানা উন্নয়নমূলক কাজ হবে। এসব কাজে ব্যবহৃত পানি সুন্দরবনের পশুর নদ থেকেই তোলা হবে বলে মনে করছে ইউনেসকো।
ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজে সেখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাঁরাও সুন্দরবনে বর্জ্য ফেলছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনেসকো জানতে পেরেছে, প্রকল্প এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, খেলাধুলার জন্য মাঠ ও অন্যান্য অবকাঠামো এবং সুইমিংপুল নির্মিত হবে। প্রকল্পের আশপাশে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সম্পত্তি বা জমি বিক্রি হওয়ার প্রমাণও প্রতিনিধিদলটি দেখতে পেয়েছে।
ইউনেসকো প্রতিনিধিদল আরও জানতে পেরেছে, রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। রামপালের প্রথম পর্যায়ের জন্যই সুন্দরবনে মিষ্টি পানি কমে আসবে, এই মত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় নির্মিত হলে সেই ক্ষতি আরও বাড়বে।
জাহাজ চলাচল বেড়ে যাওয়া
রামপাল প্রকল্পের জন্য কয়লা আনার পথ হিসেবে পশুর নদকে বেছে নেওয়ার তথ্য উল্লেখ করে ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল প্রকল্পের কয়লা পরিবহনের এই পথটি সুন্দরবন লাগোয়া। কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের পথটি সুগম রাখতে ৩৫ কিলোমিটার নদীপথ খনন করতে হবে। এতে ৩ কোটি ২১ কিউবিক মিটার মাটি নদী থেকে খননের মাধ্যমে উত্তোলন করা হবে।
প্রতিবছর এই খনন চালিয়ে যেতে হবে। খনন থেকে আসা বিপুল এই পলিমাটি কোথায় রাখা হবে এবং তা সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তার পর্যালোচনা সঠিকভাবে হয়নি বলে মনে করছে ইউনেসকো।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী অধ্যাপক রেজা খান বলেন, ‘আমি অনেকবার বলেছি, আবারও বলছি যে রামপাল প্রকল্প থেকে যে দূষিত উত্তপ্ত পানি পশুর নদে ফেলা হবে, তাতে নদের পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। এর ফলে বনের প্রাণীদের প্রাথমিক খাদ্য উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্যচক্র ধ্বংস হবে, যা সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনের পুরো প্রতিবেশব্যবস্থাকে বড় ধরনের বিপদে ফেলবে।’
রেজা খান মনে করেন, সুন্দরবনের প্রতি ইঞ্চিতে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রয়েছে। হাজার-লক্ষবার চেষ্টা করেও এ ধরনের একটি বন তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত ইউনেসকোর সুপারিশ আমলে নেওয়া।
১
বায়ুদূষণ: রামপাল প্রকল্পের চিমনির উচ্চতা হবে ৯০০ ফুট। এই উঁচু চিমনির কারণে দূষিত বাতাস দূষণ ছড়াবে
২
পানিদূষণ: প্রতি ঘণ্টায় ৫ হাজার কিউবিক মিটার পানি পশুর নদ থেকে তোলা হবে। দূষিত পানি সুন্দরবনের নদীতে ছাড়া হবে
৩
পুঞ্জীভূতদূষণ: রামপালে শহর ও প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মিত হবে। এসব কাজে ব্যবহৃত পানি সুন্দরবনের পশুর নদ থেকেই তোলা হবে
৪
জাহাজ: কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের পথটি সুগম রাখতে ৩৫ কিলোমিটার নদীপথ খনন করতে হবে। এতে ৩ কোটি ২১ লাখ ঘনমিটার মাটি নদী থেকে উত্তোলন করা হবে।খবর প্রথম আলো’র।
মন্তব্য চালু নেই