রামপালে ব্যবহার হবে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ার কয়লা

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতের কয়লা ব্যবহার করা হবে না। ভারতের কয়লা নিম্নমানের হওয়ায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেসব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে, নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করা হলে সেসব মেশিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হবে। সেভাবেই এ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই এই তিনদেশ সফর করে দেশে ফিরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এই তিনদেশের কয়লা উপযোগী বলে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

প্রতিনিধিদলের সদস্য পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন জানান, ‘নিম্নমানের বলেই প্রকল্পের প্রস্তাবেই ভারতের কয়লার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। তদুপরি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ভারতের কয়লা ব্যবহার করা হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র ফল করবে। তাই সেখানে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করা হবে। ভারতের চেয়ে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লার মান অনেক ভালো।’

জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লায় সালফারের মাত্রা কম। কিছুটা দাম বেশি পড়লেও এই কয়লা পরিবেশের জন্য সহনশীল। এতে শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ সালফার থাকে। বিপরীতে ভারতের কয়লায় শতকরা ৬ থেকে ৭ ভাগ সালফার পাওয়া যায়। অথচ পরিবেশ আইনে শতকরা ১ ভাগের চেয়ে বেশি সালফার থাকা কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ। ভারতীয় কয়লায় সালফার বেশি থাকে।

এক প্রশ্নের জবাবে মোহম্মদ হোসাইন বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা সরবরাহে টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। টেন্ডারের শর্ত ও নিয়মকানুন মেনেই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কয়লা সরবরাহ করবে। সেখানে সরকারের কিছুই করার নেই।’ ভবিষ্যতে ফুলবাড়ির কয়লা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে ‘ফুলবাড়ি থেকে রামপাল’। কয়লা পরিবহনের মাধ্যম কী? নৌপথ তো নেই। সড়ক পথে কি রামপালের জন্য কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব? কারণ, প্রতিদিন রামপালে ১০ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হবে। তাহলে ফুলবাড়ি থেকে রামপালে কয়লা নিতে হলে লাগবে রেলপথ। লাগবে ওয়াগন। তা কি আমাদের আছে? আর নতুন করে এই লাইন নির্মাণ করা এবং প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ওয়াগন আনতে গেলে এর ব্যয় সম্পর্কে ধারণা আছে? কাজেই এই চিন্তাই কল্পনাপ্রসূত। তবে বর্তমানে এ সংক্রান্ত কোনও চিন্তা বা পরিকল্পনা বিদ্যমান প্রকল্পে নেই।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লা উন্নতমানের। এই তিনদেশের কয়লা ভারতের চেয়ে অনেক ভালো। তাই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য ভারত নয়, সংশ্লিষ্টরা ওই তিনদেশের কয়লার বিষয়টি সুপারিশ করেছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতিটন উন্নতমানের কয়লার দর সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। তবে নিম্নমানের কয়লা অর্থাৎ মানভেদে তা ৫০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে।

আমদানিকারকরা জানান, ‘বিশ্বব্যাপী এখন কয়লার দাম কমছে। এবার ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রচুর কয়লা আমদানি হচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ টন। বিপরীতে সিলেটের বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ টন কয়লা। আগের বছরগুলোয় এ সময়ে ভারত থেকে কয়লা আমদানির স্বাভাবিক পরিমাণ ছিল ১৭ থেকে ২০ লাখ টন।’ একদিকে মান ভালো নয়, অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ায় আমদানি কারকরা ভারত থেকে কয়লা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।

সিলেট কয়লা আমদানিকারক সমিতি সূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে প্রতি টন কয়লা কিনতে হয় ৮৫ ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৬৯২ টাকা) মূল্যে। দেশে আনার পর এই কয়লা বিক্রি হয় প্রতি টন সাড়ে ৭ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত প্রতি টন কয়লার দর ৫২ ডলার (প্রায় ৪ হাজার ৯৪ টাকা)। দেশে আনার পর এর বিক্রিমূল্য দাঁড়ায় ৬ হাজার টাকা। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করলেও এমন দামই পড়বে বলে জানান আমদানিকারকরা। দামের এ তারতম্যই ভারতের বদলে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ার মূল কারণ।

কয়লা আমদানিকারক সমিতি সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর কয়লার চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন। দেশের ইটভাটা, চায়ের দোকান, রি-রোলিং স্টিল মিল, রাস্তা তৈরি ও সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়লা ব্যবহার হয়।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বরাতে জানা যায়, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে প্রতি বছর ৮ লাখ থেকে ৯ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলিত এই কয়লা প্রতিবছরই সরকারের বিপিডিবির মালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া ২৫০-৩০০ মেগাওয়াট (তৃতীয় ইউনিট) বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটানোর পর কোনও কোনও বছর সামান্য পরিমাণ কয়লা স্থানীয় ইটভাটাগুলোকে দেওয়া হয়। দেশের ভেতরের আর কোনও কয়লা খনি থেকে এখনও কয়লা উত্তোলন করা হয় না। অথচ রামপাল তাপ বিদ্যুৎসহ কয়লাভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ১ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে বছরে আরও অতিরিক্ত ৪৫ লাখ টন কয়লা লাগবে। যা বর্তমানে সারা দেশের মোট ব্যবহৃত কয়লার সমান।



মন্তব্য চালু নেই