রাণীনগরে ভূমি অফিস এখন সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত ॥ দালাল আর ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ভূমি অফিস বর্তমানে সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত ও হয়রানী আর ভোগান্তির শীর্ষের অফিস বলে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও কাননগো’র মত গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ শূন্য থাকায় দালাল আর ঘুষের চাদরে ঢেকে গেছে। বর্তমানে এই অফিসের দূর্বাঘাস পর্যন্ত ছোট-বড় যে কোন কাজে ঘুষ চায়।

অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া এই অফিসের পদস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কোন পরামর্শ বা কথা বলার কোন অবকাশ নেই। বর্তমানে এই অফিসে নির্ধারিত কতিপয় প্রভাবশালী দালাল আর ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হয় না। এতে করে চরম হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা হাজার হাজার সাধারণ মানুষদের।

যার কারণে জমি সংক্রান্ত ছোট বিষয়ও খুবই জটিল সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘদিনের রেখে আসা জমি সংক্রান্ত কোন সমস্যা সমাধান করতে এই অফিসে ঘুষ দিতে দিতে আজ অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়ে গেছে। আর এই সুযোগেই কিছু কতিপয় দালাল সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তারা অতিরিক্ত অর্থ খেতে খেতে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। ঘুষ দিতে না পারায় প্রতিদিন শত শত মানুষ এই অফিসে এসে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে নিরাশ হয়ে চলে যান বাড়িতে।

জানা জানা, গত ৫আগষ্ট ১২ইং তারিখে তৎকালীন সহকারি কমিশার (ভূমি) নূর উদ্দিন আল-ফারুক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্যে বিদেশ চলে যাওয়ার পর থেকে প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে উপজেলা প্রশাসনের ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ন এই পদ শূন্য রয়েছে। আর এই সুযোগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে এই অফিসকে। এখানে জমির জাবেদা কপি নিতে এলে ঘুষ দিলে পাওয়া যায় তা না হলে এক মাসেও তার কোন খবর থাকে না। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের উদ্দ্যেশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছে মতো নোটিশ জারি করে আদায় করেন হাজার হাজার টাকা।

এতে করে জমি সংক্রান্ত কোন মামলা না থাকলেও প্রতিপক্ষ ভয়ে অফিসে এসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য হোন। অনেক সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে ২ থেকে ৫০টাকার জমির খাজনার চেক দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে আদায় করেন ৪’শ থেকে ৫’শ টাকা। বছরের পর বছর ঘুরে জমির খাজনা দিতে পারছেন না অনেক সাধারণ মানুষ। জমির খাজনা পরিশোধ করার জন্য মানুষ হয়রানি আর ভোগান্তির ভয়ে মোটা অংকের ঘুষ দিতে বাধ্য হোন। টাকা না দিলেই জমি সংক্রান্ত যে কোন ডুপ্লিকেট কার্বন কপি ( ডিসিআর) রেখেও বলে নেই”। জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার সুনানির ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাদের পছন্দমতো দীর্ঘ সময়ের তারিখ প্রদান করেন।

এই ভূমি অফিস কোন মামলা সমাধান না করে তা ঝুঁলিয়ে রেখে অর্থ আদায় করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আরএস প্রিন্ট খতিয়ান সহজেই পাওয়ার কথা থাকলেও তা নিতে প্রতি কপিতে ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা করে নেওয়া হয়। দালাল ছাড়া কোন কাজ করলে তা আরও দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে থাকে। জমি সংক্রান্ত বিগত মামলা সম্পর্কে জানার জন্য গেলে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে ১ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

সরকারি নিয়ম অনুসারে জমির খারিজ সিরিয়াল মোতাবেক হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবে করা হয় না। ভূমি কমিশনারের নাম ভেঙ্গে ও দালালদের মাধ্যমে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিলেই খারিজের সব অনিয়ম এখানে নিয়মে পরিণত হয়। জমির খাজনা গ্রহণের ক্ষেত্রে হোল্ডিং যাচাই-বাচাই না করেই একই সম্পত্তি একের অধিক ব্যক্তির নামে টাকার বিনিময়ে খাজনার চেক প্রদান করার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বর্তমানে অনিয়মই যেন এই বিভাগের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিসে শুধুমাত্র এমএলএস ছাড়া অন্যান্য কর্তা বাবুরা আসেন তাদের ইচ্ছেমত। এযেন তাদের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাপ-দাদার সম্পত্তি। তারা যা বলেন সেটাই এই অফিসের নিয়ম আর নীতি। সরকারি কোন বিধি-বিধান এই বিভাগের কোন কর্তা বাবু পালন করেন না বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

প্রায় ৩ বছর যাবত এখানে সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) পদ শূন্য থাকায় এখানকার সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত এক একজন ভূমি কর্মকর্তা বনে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই কাজ না হওয়ার ভয়ে সাধারণ মানুষরা তাদের সব দূর্নীতি হজম করে আসছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেরই অভিযোগ। টাকা হলেই জমি সংক্রান্ত সকল প্রকার অসম্ভব এখানে সম্ভব হয়ে যায়। দালালদের খোপ্পরে পড়ে জমি সংক্রান্ত যে কোন ছোট-বড় কাজে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার তিন গুণ পরিমাণ টাকা দিতে হয়।

বিনা পরিশ্রমে দালালরা সাধারণ মানুষদের সহযোগিতার বদলে তাদের রক্ত চুষে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই অফিসটি আর সরকারি কোন বিভাগ নয় এটি কতিপয় দালালদের জন্য এক নিরাপদ অভয়ান্যে পরিণত হয়েছে। তবুও সবকিছু জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জটিল এই সমস্যা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য কোন প্রদক্ষেপই আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। এযেন কর্তৃপক্ষের জেগে থেকেও ঘুমানোর ভান। কবে রাণীনগর উপজেলা বাসী এই ঘুষ আর হয়রানির ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবে তা এখন অজানার দেশে।

উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসেরও একই চিত্র । কিছু কিছু ইউপি ভূমি অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ঘুষ আর হয়রানির একই চিত্র। টাকা না দিলেই আজ নয় তো কাল, কাল নয়তো পরশু, এভাবে হয়রানি করা হয় দিনের পর দিন। খাজনার চেয়ে বাজনা অনেক বেশি বলে অনেক গরীব মানুষ তাদের জীবনদশায় জমির কোন সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না।

ফলে জমি সংক্রান্ত অনেক ছোট সমস্যা দিনের পর দির আরও জটিল আকার ধারণ করছে। জটিল সমস্যার এই সুযোগে ভূমি অফিসের সহযোগিতায় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জবর-দখল করে নিচ্ছে বিঘার পর বিঘা জমি আর দীর্ঘদিন ভোগ দখল করে আসা জমি হারিয়ে উপজেলার অনেক অসহায় পরিবার আজ পথে বসেছে। ইউপি ভূমি অফিসে টাকা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায় কোন মতে শেষ হলেও উপজেলা ভূমি অফিসে এসে আবার দালালদের মাধ্যমে দিতে হয় মোটা অংকের টাকা।

টাকা না দিলেই ঐ কাজ আর কখনও আলোর মুখ দেখতে পায় না। জমি খারিজ করতে না পারায় এবং সেই জমি বিক্রয় না হওয়ায় অনেক গরীব পরিবার তাদের মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিতে না পারার দৃষ্টান্তর রয়েছে। খারিজ সংক্রান্ত কাজে বেশি সময় লাগার কারণে জমির মালিকরা প্রয়োজন মতো তাদের পারিবারিক কাজ করতে পারছেন না। এই সুযোগ বুঝে কতিপয় দালালরারা জমির মালিকদের ভূমি সংক্রান্ত কাজ দ্রুত করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার শত শত অভিযোগ পাওয়া গেছে ।

বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকলেও প্রশাসনিক কাজ-কর্মের কারণে বেশি সময় ব্যস্ত থাকায় নির্ধারিত তারিখে জন সাধারণের ভূমি সংক্রান্ত কাজ করতে মাঝে মধ্যেই বিলম্বিত হয়। ফলে জন দূর্ভোগের ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই সুধি মহলের দাবি জনদূর্ভোগ লাঘব করার লক্ষে যত দ্রুত সম্ভব এই উপজেলায় সহকারি কমিশনার (ভূমি) শূন্য পদ পূরণ করে এই বিভাগটিকে দূর্নীতির আখড়া থেকে মুক্ত করার জন্য নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও বিভাগী কমিশনারের সুনজর কামনা করেছেন।

উপজেলার কালিগ্রাম গ্রামের মোজাফ্ফর হোসেনে ছেলে আব্দুল মোমিন অভিযোগ করে বলেন, তিনি ভূমি অফিসের কর্তা বাবুর চাহিদা পূরণ না করায় তার ক্রয়কৃত প্রায় ৯বিঘা জমির খারিজ প্রায় ২বছর যাবত ঘুরে আজ পর্যন্ত করতে পারেননি।

উপজেলার কনৌজ গ্রামের আকবর আলীর ছেলে আব্দুল গাফ্ফার জানান, তার পিতার দেওয়া জমি খারিজ করার জন্য ভূমি আফিসে তিনি দীর্ঘ প্রায় এক বছর যাবত অপেক্ষার প্রহর গুনেও এখনে মেলেনি জমি খারিজের রশিদ ।

উপজেলার আবাদপুকুর এলাকার পত্রিকা এজেন্ট আব্দুর রহমান জানান, ভূমি অফিসের দালাল উপজেলার নারায়নপাড়ার দলিল লেখক বাবু জমি খারিজ করে দেওয়ার বিষয়ে আমার কাছ থেকে প্রায় ৫হাজার টাকা নিলেও আজ প্রায় ১বছর যাবত আমার জমি খারিজে রশিদ পাইনি।

উপজেলা সার্ভেয়ার সুনীল চন্দ্র সরকার জানান, এই সব দূর্নীতির বিষয়গুলো সম্পূর্ন মিথ্যে। আমরা চেষ্টা করি সব কাজ দ্রুত করার জন।

রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, আমার দপ্তর থেকে প্রায় দুই লক্ষ মানুষের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার পর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাকে ভূমি অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে এসিল্যান্ডের শূন্য পদে লোক দিলে আর ভোগান্তি হবে না বলে তিনি জানান।#



মন্তব্য চালু নেই