রাজশাহীর মেয়ে রিতার অলিম্পিকে সোনা জয়ী

সরকার দুলাল মাহবুব, রাজশাহী থেকে: জয় হলো বাংলার বাঘিনী খ্যাত সেই মার্গারিতা মামুন ওরফে রিতার। ‘বাংলাদেশি কন্যা’ মার্গারিতা মামুন জিতে নিলেন অলিম্পিকের গোল্ড মেডেলে। বাঙালি-রুশ এই মেয়ে রিদমিক জিমন্যাস্টিক্সের ব্যক্তিগত অল-অ্যারাউন্ডে রিও অলিম্পিকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। স্বদেশি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইয়ানা কুদ্রিয়াভসেভাকে পেছনে ফেলে শনিবার হয়েছেন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।

২০ বছরের রিতা ২৬ জনের বাছাইয়ে হয়েছিলেন প্রথম। তার ইভেন্টে তিনিই বিশ্বের সেরা। বিশ্ব রেকর্ডও তার। কেবল তা অলিম্পিকের মতো বিশ্ব মঞ্চে প্রমাণের অপেক্ষা ছিল। সেই কাজটি বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে করে ফেললেন ‘রিতা’। বাংলাদেশি বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন শিপার ও রুশ মা আন্নার সন্তান আলো ছড়ালেন রুশ অলিম্পিক অ্যারেনায়। শৈল্পিক জিমন্যাস্টিক্সের মহোয় সবাইকে ডুবিয়ে রেখেই গোল্ড মেডেল জিতলেন তিনি।

রাশিয়ান মিডিয়া গুলোর দেয়া তথ্যমতে, গত ১৮ বছরে ইয়ানা ছিল রিতার কাছের বন্ধু। কিন্তু বড় আসরে তাকে হারানো যাচ্ছিল না। বাছাইয়ে সেই কাজটি করেছিলেন রিতা। সেখানে কিছু ভুল ছিল ইয়ানার। ফাইনালে ঘুরে দাঁড়িয়ে রিতা হতাশ করতে পারেন সেই সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু অদম্য পারফরম্যান্সে ৭৬.৪৮৩ স্কোর করে রিতা হেসেছেন সোনালি হাসি। ৭৫.৬০৮ স্কোর করে কেবল রূপা নিয়ে সন্তুষ্ট ইয়ানার। ইউক্রেনের গানা রিজাতদিনোভা জিতেছেন ব্রোঞ্জ। এ নিয়ে ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিক থেকে টানা পঞ্চমবার ইভেন্টটির সোনা জিতল রাশিয়া।

রিতার বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন শিপার বর্তমানে মরনব্যাধি ক্যান্সারে ভূগছেন। রবিবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে ইমোতে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, জুনিয়র পর্যায়ে মার্গারিতা কিছুদিন বাংলাদেশের পতাকা তলে প্রতিযোগিতা করেছেন। সেটি অল্প সময়ের জন্য। মস্কোর মেয়ে শেষ পর্যন্ত সিনিয়র পর্যায়ে মায়ের দেশ রাশিয়াকেই বেছে নিয়েছেন। তবু তার অলিম্পিক সোনা জয়ের কীর্তির গৌরব ছড়িয়েছে বাংলাদেশ ও গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুরের ক্ষিদ্র কাশিপুর গ্রামে। কারণ, বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি এখন ‘দ্য বেঙ্গল টাইগার’।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি তার ফেসবুক পেইজে দাবি করেছেন, ১/১১ এর সময় রিতা বাংলাদেশের হয়ে খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তার বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন সে সময় বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনে যোগাযোগ করেছিলেন বাংলাদেশের হয়ে রিতাকে অংশ গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু সে সময়ের সেনা শাসিত সরকার তার কথায় কোন রকম পাত্তাই দেননি। তবুও রিতার এই সাফল্যে বাংলাদেশী হয়ে গর্ব করতেই পারি।

শনিবার রিও অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণ পদক পাওয়ায় রাজশাহীর দুর্গাপুরের মেয়ে রিতাকে নিয়ে এখন রীতিমতো দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় হইচই পড়ে গেছে। দুর্গাপুরের মেয়ে হয়েও বর্তমানে সোভিয়েত রাশিয়া কাঁপানো এই জিমন্যাস্টিক কন্যার খেতাব দেয়া হয়েছিল ‘বাংলার বাঘিনী’। আর এই খেতাব তাকে দিয়েছিলেন রুশ কোচ ইরিনা ভিনের। রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যম গুলোতেও এ নামেই তাকে অভিহিত করা হয়েছে।
¯¦র্ণ পদক জয়ের আগে রাশিয়ার রিদমিক জিমন্যাস্টিকের ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে তার অবস্থান বর্তমানে ২ নম্বরে। দুর্গাপুর বাসীর জন্য যা কিনা সত্যি গর্বের ও একই সাথে অনেক আনন্দের। গত বছরের ১৫ মে বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাথে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল রিতার। কিন্তু পরবর্তিতে ব্যাস্ততার কারনে তার আর দেশে আসা হয়নি।

রিতার বংশ পরিচয়: ২০১৩ সালে রিতার গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যের কারণে তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় রাশিয়ার ক্রীড়াঙ্গনে। রাশিয়ার বিখ্যাত ক্রীড়া ম্যাগাজিন ইউরো স্পোর্টস এর মূল প্রচ্ছদে উঠে আসে রিতার সাফল্যের গল্প। রিতার বাবা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন (গ্রামে ডাক নাম শিপার) রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ক্ষিদ্র কাশিপুর গ্রামের ছেলে। ১৯৮৩ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি সোভিয়েত রাশিয়া যান। পরে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান। বাংলাদেশী বংশদ্ভুত এই রিতাকে বিশ্ব গণমাধ্যম অন্য এক নামে চেনে। সেখানে তার নাম ‘মার্গারিতা মামুন’। ঠিক এই নামেই এই রিদমিক জিমন্যাস্টিকে চেনেন বিশ্ববাসী। রিতার রক্তে বইছে জিমন্যাস্টিকস।

১৯৯৫ সালের ১ নভেম্বর রাশিয়ার মস্কোতে জন্ম নেয়া রিতার বাবা বাংলাদেশী বংশদ্ভুত আবদুল্লাহ আল মামুন প্রকৌশলী হলেও তার মা রাশিয়ান বংশদ্ভুত আন্না একজন পেশাদার রিদমিক জিমন্যাস্টিক ছিলেন। তাই ছোট বেলা থেকেই জিমন্যাস্টিকস চর্চা চালিয়ে গেছেন রিতা। ব্যাক্তিগত জীবনে এখনও বিয়ে করেননি রিতা। তার একটি ছোট ভাইও আছে। নাম ফিলিপস। বর্তমানে তারা সপরিবারে রাশিয়ার মস্কোতে বসবাস করছেন।

রিতার বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুনের বড় ভাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধাণ শিক্ষক এ.এস.এম খসরু জানান, তাদের বাবা মৃত আব্দুল খালেক ছিলেন একজন নামকরা কাপড় ব্যাবসায়ী। মা মেহেররুন নিসা ছিলেন গৃহিনী। তিনিও মারা গেছেন ২০১২ সালে। তাদের সাত ভাই বোনের মধ্যে মামুন সবার ছোট। মেঝ ভাই আব্দুল মোতালিব জনতা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। সেজো ভাই ডা. আব্দুল মান্নান নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। বড় বোন বিণা জহুরা খাতুন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চাকুরি করতেন। সেজো বোন জিনাত আরা গৃহিনী। তিনি স্বামী সংসার নিয়ে ঢাকার রূপনগরে বসবাস করেন। ছোট বোন ফজিলা আলমও গৃহিনী। তিনিও স্বামী সংসার নিয়ে ঢাকার আরামবাগে বসবাস করেন।

বাংলাদেশে রিতার শৈশবকাল: রিতার ফুফাতো ভাই শামসুজ্জোহা জানান, রাশিয়ার রিদমিক জিমন্যাস্ট দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রিতা। বেশ কয়েক দফা বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলতে পারেন। ১৯৯৫ সালের ১ নভেম্বর জন্ম নেয়া রিতা সাত বছর বয়স থেকেই রিদমিক জিমন্যাস্টিকস চর্চা শুরু করেন। ২০০৫ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ তাঁর। রিতা জুনিয়র হিসেবে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। জুনিয়র পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়েও প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন তিনি। তবে এক পর্যায়ে রাশিয়ার হয়েই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রিতা।
আসলে কি এই রিদমিক জিমন্যাস্টিকস?

জিমন্যাস্টিকস বলতে মূলত; শারীরিক কলা-কৌশল প্রদর্শনের ক্রীড়াবিশেষ। যাতে দৌঁড়, লাফ, ডিগবাজী, সমার সল্টিং এবং ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট থাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে চার ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- ফ্লোর, বার (ক্রীড়া), বীম এবং ভল্ট উপকরণাদি ব্যবহার করা হয়। এ ক্রীড়ায় যে প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে থাকেন তিনি জিমন্যাস্ট নামে পরিচিতি লাভ করেন। জিম্যানস্টিকসে একজন প্রতিযোগী অন্য প্রতিযোগীর মোকাবেলা করে থাকে। সেখানে সবচেয়ে ভালো ক্রীড়াশৈলীর প্রদর্শনের মাধ্যমে যোগ্যতা ও বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। অলিম্পিক ক্রীড়ায় জিমন্যাস্টিকস অন্যতম প্রধান ক্রীড়া বিষয় হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে শুধুমাত্র মহিলা ক্রীড়াবিদগণই অংশগ্রহণের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত। শৈশবকাল থেকেই এতে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি-পর্ব গ্রহণ করতে হয়। বয়সের যোগ্যতা অনুসারে তাদেরকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। ১ জানুয়ারিতে একজন জিমন্যাস্টের বয়স অবশ্যই ১৬ বছর হতে হবে।

রিতার সাফল্য গাঁথা:২০১১ সাল থেকে রিতার খেলোয়াড়ী জীবনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসতে শুরু করে। ২০১১ সালে মন্ট্রিল ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নিয়ে ১০৬.৯২৫ পয়েন্ট অর্জন করে অল-অ্যারাউন্ডে ব্রোঞ্জ পান রিতা। আর বল ফাইনালে ২৭.০২৫ পয়েন্ট নিয়ে স্বর্ণ জিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ওই বছর রাশিয়ার চ্যাম্পিয়নশিপে হুপ ও বলে অল-অ্যারাউন্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় দলে ডাক পড়ে যায় তার। উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী রিতা রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে সবমিলিয়ে সিলভার মেডেলিস্ট এবং ২০১৩ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে ‘অল অ্যারাউন্ড’ চ্যাম্পিয়ন।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রিতাকে। শুরু হয়ে যায় তার জয়যাত্রা। ২০১১ সালে তার ওয়াল্ড র‌্যাংকিং ছিল ২২। যা কিনা ২০১২ সালে হয়ে যায় ১৭। কিন্তু ২০১৩ সালে এক লাফে ওয়াল্ড র‌্যাংকিংয়ের ১ নম্বরে চলে আসেন তিনি। মস্কো গ্রান্ড প্রিক্সে স্বর্ন জেতার মধ্য দিয়ে মৌসুম শুরু করেন। এরপর কাজান ইউনিভার্সিয়াড, সেন্ট পিটার্নবার্গ ওয়াল্ড কাপ ফাইনাল, ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ওর্য়াল্ড চ্যাম্পিয়নশীপের মতো বড় ক্রীড়া ইভেন্ট গুলোতে রিতা তার যোগ্যতার পরিচয় দেয়। বর্তমানে রিও অলিম্পিকে ¯¦র্ণ জয়ের আগে তিনি ছিলেন ওর্য়াল্ড র‌্যাংকিংয়ের ২ নম্বরে। রিতার এগিয়ে চলার শানিত ফলা ঠিক একই রকম আছে। গত বছর জার্মানির স্টুটগার্টে আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় রিতা তিনটি স্বর্ণ পদক, একটি সিলভার এবং একটি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন।

প্রসঙ্গত, রাশিয়ার ক্রীড়াঙ্গনে কোন বাংলাদেশী বংশদ্ভুত নাগরিকের এটাই বড় সাফল্য। তাই রিতার এই অর্জনে সে দেশের বাংলাদেশী কমিউনিটির মানুষ খুবই খুশি। এমনকি ফেইসবুক, টুইটার ও ইন্সটাগ্রামে তারা রিতার প্রতিযোগিতার ছবি প্রকাশ করেছেন। একই সাথে রিতার বাবা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনের জন্ম স্থান রাজশাহীর দুর্গাপুরের ক্ষিদ্র কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দারাও ভাসছেন আনন্দের বন্যায়।



মন্তব্য চালু নেই