রাজনীতিতে শ্রমিক সমাজ

রাজনীতিতে শ্রমিক সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনীতির সাথে শ্রমিক সমাজের সম্পর্ক এমনভাবে জাড়িয়ে আাছে যে এদেরকে আলাদা করা যায় না। রাজনীতি এবং শ্রমিক সমাজ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। শ্রমিক সমাজকে বাদ দিয়ে রাজনীতি চলতে পারে না। আবার শ্রমিকরা রাজনীতির বাইরে থেকে নিজের কল্যাণ সাধন করতে পারে না। তাই বলা যায় রাজনীতি এবং শ্রমিক সমাজ একে অপরের পরিপূরক। ফলে রাজনীতিতে শ্রমিক সমাজ অথবা শ্রমিক সমাজে রাজনীতি কিংবা রাজনীতি এবং শ্রমিক সমাজ বিয়ষগুলো নিয়ে এভাবেই ভাবা যায়।

বহুল পরিচিত আজকের রাজনীতি সম্পর্কে একবাক্যে বলা চলে শ্রমিক শ্রেনীই রাজনীতিকে গতিশীল, ঝদ্ধ, শুদ্ধ করেছে। শ্রমিক শ্রেনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহনের ফলেই রাজনীতি গণমুখী হতে পেরেছে। যদিও রাজনীতির প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিল তবু শ্রমিক সমাজের অংশগ্রহনের মাধ্যমেই রাজনীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। আগে রাষ্ট্র ছিল, রাজ্য ছিল, সরকার ছিল, প্রজা ছিল। রাজার সাথে প্রজার, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের দুরত্ব ছিল বিশাল। শাসনের সাথে শোষন শব্দটি ছিল জড়িত। রাজ্য, রাষ্ট্র পরিচালিত হতো একটা নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনে তবে তা আজকের মতো লিবারেল ছিল না। কালের বিবর্তনে রাজনীতির রুপ পাল্টেছে রাজনীতিতে সাধারন মানুষের অংশগ্রহন বেড়েছে, রাজনীতি আজকে সার্বজনীন অধিকারে পরিনত হয়েছে।

আদি থেকে মানব সভ্যতা কৃষি নির্ভর। কৃষি কাজই ছিল অধিকাংশ মানুষের একমাত্র কিংবা প্রধান পেশা। তাই রাষ্ট্রের রাজনীতি মূলত কৃষি নির্ভর ছিল। পরে কল কারখানার বিস্তার ঘটলে শ্রমিক সমাজের আর্বিভাব ঘটতে শুরু করে। সমাজে নতুন এই শ্রমিক শ্রেনীর রাজনীতি সচেতনতা পৃথিবীর পুরো রাজনৈতিক ধারা-উপধারাকে পাল্টে দেয়। প্রাসাদ কেন্দ্রীক-ব্যক্তি কেন্দ্রীক রাজনীতি চর্চার চির পরিচিত চিত্র পাল্টে গিয়ে রাজনীতি হয়ে উঠতে থাকে গণমূখী। খেটে খাওয়া, ঘাম জড়ানো মেহনতী মজদুর শ্রমিক শ্রেনী শোষনের তিব্র দহনে জ্বলে উঠে। ঘুরে দাঁড়ায় শ্রমিক শ্রেনী। আর এই শ্রমিক শ্রেনী পুরো রাজনীতির চিত্রটাই পাল্টে দেয়। রাজনৈতিক অংগনে শ্রমিকদের দ্বারা সৃষ্ট মহান মে দিবসের গুরুত্ব-তাৎপর্য এবং এর প্রতিক্রিয়া ব্যাপক। মে দিবস যদিও শ্রমিক শ্রেনীর সরাসরি অংশগ্রহনের ফল কিন্তু এর সুফল ভোগ করছে সর্বস্তরের নির্যাতিত নিপীড়িত আমজনতা তথা সমগ্র রাজনৈতিক অংগন। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে আজকে রাজনীতির যে ব্যাপকতা, সার্বজনীনতা এর অন্যতম উৎস শ্রমিক সমাজের রাজনীতি সম্পৃক্ততা। শ্রমিক শ্রেনীর রাজনীতি সচেতনতার অন্যতম অবদান বলা চলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার রাজনীতি। সমাজতান্ত্রিক চিন্তার উদ্ভব ঘটার পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরন শুরু হয়।

সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কস-এঙ্গেলসরা প্রথমবারের মতো কল কারখানায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবি মেহনতী মানুষদের চিন্তা চেতনায় প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকারের ইচ্ছার নার্ভগুলো জাগিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। অধিকারহীন এসব মানুষ অধিকারের চেতনায় ধীরে ধীরে জেগে উঠে। আজন্ম লালিত সুপ্ত অধিকার প্রাপ্তির আশায় মানুষ বিপ্লবী হয়ে উঠে, রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠে। আর এভাবেই প্রচলিত রাজনীতিতে নতুন ধারার প্রবর্তন ঘটে। রাজনীতিও সচল হতে থাকে। শ্রমিকদের রাজনীতি সচেতনতা, স¤পৃক্ততার কারনে রাজনীতিতে তাদের93af53b49e5891036596b5cb22dc8060-Somik গুরুত্ব বাড়তে থাকে। রাজনীতিতে শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহন রাজনীতিকেও গতিশীল করে তোলে। শ্রমিক সেক্টরে শ্রমিকদের নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবি মানুষ রাজনীতির একটি সিষ্টেমে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করে। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমজীবী মানুষকে সংঘবদ্ধ করে, সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমজীবি মানুষ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আন্দোলন করার অধিকার অর্জন করে শোষন মুক্তির পথ খুঁজে পায়। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হবার পর থেকেই রাজনীতির অংগনে নতুন গতি আসে।

আমাদের এ অঞ্চলের রাজনীতিতে সর্বপ্রথম সংগঠন হিসাবে কংগ্রেস এর কর্মকান্ড পরিচালিত হবার পর উনিশ শতকের প্রথম দিকে কমিউনিজ্যমপন্থী বাম সংগঠন এ অঞ্চলের শ্রমিকদেরকে রাজনীতি সচেতন করার উদ্যোগ নেয়। বাম চেতনার এসব রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে এসে শ্রমিকরাও বাম রাজনীতিতে উদ্ধুদ্ধ হয়। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে গত শতাব্দীর শুরুতে শ্রমিক রাজনীতি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তান আমলে আমাদের এ অঞ্চলের রাজনীতিতে শ্রমিক সমাজের অবদান ছিল। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের মেহনতী শ্রমিক শ্রেনীর স্বতঃস্ফ’র্ত অংশগ্রহন ইতিহাস স্বীকৃত।

স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতি তেমন গতিশীল না থাকলেও শ্রমিক রাজনীতি আছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল এর অংগসংগঠন হিসাবে শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, কমিউনিষ্ট পার্টি ওয়ার্কাস পার্টির শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন, জামায়াতে ইসলামীর শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ রয়েছে। এছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকায় বর্তমানে দেশের প্রায়ই সকল প্রতিষ্ঠানেই শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। বেসিক ইউনিয়নগুলোও আবার ফেডারেশনভূক্ত হয়ে শ্রমিক রাজনীতি চর্চার সুযোগ পাচেছ। তবে এটা বাস্তব সত্য যে, বাংলাদেশে শ্রমিক রাজনীতির চর্চা এবং সুযোগ পেলেও শ্রমিকরা রাজনীতি সম্পৃক্ত থেকেও প্রকৃত অর্থে শ্রমিক সুবিধা অর্জনে সক্ষম হয়নি। আজও শ্রমিকরা শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। শ্রমিক রাজনীতি থেকে শ্রমিকরা বঞ্চিত হওয়ার জন্য একদিকে নিজেরা যেমন দায়ী অন্যদিকে মালিক পক্ষ কিং1421305341_15758_2বা সরকারও অনেকক্ষেত্রে দায়ী। আর এটাতো স্বাভাবিক যে সরকার এবং মালিক পক্ষ শ্রমিকদের প্রতিকুলে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলো দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও শ্রমিক সমাজের কল্যানে উদাসিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের ক্ষমতা আহরন কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে শ্রমিক সমাজকে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

ক্ষমতাসীন দলকে দেখা যায় শ্রমিকদের প্রকৃত কল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা না নিয়ে উল্টো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে অপরদিকে বিরোধী দলকেও শ্রমিকদের কল্যাণে আন্তরিক হতে দেখা যায় না। অবহেলিত শ্রমিক সমাজ রাজনীতির শাখের করাতে পিষ্ট হয়েই যায় অর্থাৎ সরকার দলের সমর্থনপুষ্ট হয়েও সরকারের কাছ থেকে পায় অবহেলা আর বিরোধী দল থেকেও পুরস্কার পায় উদাসীনতার মনোভাব। এছাড়া শ্রমিক রাজনীতিতে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অনেক নেতৃবৃন্দ মালিক পক্ষের সাথে গোপন আঁতাত করে সুক্ষè কৌশলে শ্রম আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে শ্রমিক সমাজের ক্ষতিসাধন করে থাকে যা শ্রমিক রাজনীতির অপপ্রয়োগ। একশ্রেনীর স্বার্থবাদী-সুবিধাবাদী শ্রমিক নেতাদের কারনে রাজনীতিতে শ্রমিক সমাজের বদনাম হয়। রাজনীতিও কলুষিত হয়।

সময়ের স্রোতে কলের চাকা ঘুরে মালিকের উৎপাদন বাড়লেও মেহনতি শ্রমিক সমাজের ভাগ্যের চাকা ঘুরে না। তবুও নিরুপায় শ্রমিক শ্রেনীকে দূর আকাশে মুক্ত বিহঙ্গে স্বপ্নের ডানা মেলে উড়ে যাবার অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাজনীতি সম্পৃক্ত থাকতেই হয় এবং থাকতে হবে। কারন শ্রমিকের জন্য চিরন্তন সত্য হলো সংগ্রাম ছাড়া মেহনীতি মানুষের মুক্তি নেই। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাজনীতিতে জড়ায় এটা যেমন সত্য তেমনি রাজনীতিও শ্রমিক সমাজের অংশগ্রহনে পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাই শ্রমিক সমাজ এবং রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক সমাজকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।

শ্রমিক সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানে রাজনীতিকে কাজে লাগাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও শ্রমিক সমাজকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার মনোভার পরিত্যাগ করে শ্রমিক সমাজের কল্যানে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদেরকে শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট রাজনীতির চর্চা করতে হবে সেসাথে রাজনৈতিক দলগুলোকে শ্রমিক বান্ধব কর্মসূচী প্রনয়নে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সুস্থ কল্যানকর-গঠনমূলক রাজনীতির বিকাশে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে শ্রমিক সমাজের কর্মকান্ড পরিচালিত করতে হবে রাজনীতি-শ্রমিক সমাজের স্বার্থেই।

লেখক-কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই