রবীন্দ্র ভাবনায় বৈশাখ
ঋতু পর্যায়ে প্রখরতপ্ত বৈশাখ গ্রীষ্ম শুরুর প্রথম মাস। অবিরাম অগ্নিবাণে শুষ্ক শীর্ণ হয়ে ওঠে প্রকৃতির অবয়ব। মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির। খাঁ খাঁ প্রান্তরে ক্লান্ত কপোতের কণ্ঠে ক্লান্তির বিষণ্নতা। নিকুঞ্জের আধেকস্ফুট পুষ্পরাশি তৃষ্ণায় কাতর। চরাচর জুড়ে নিবিড় বৈরাগ্যের ছায়ামূর্তি বন্ধন মুক্তির আকুতিতে নিয়ত উদ্দাম, দিশেহারা। তাই তার বাইরের রূপে লাবণ্যহীন রুদ্রতা। কাল বৈশাখীর প্রমত্ততায় অনাসক্তির দীক্ষা তার অন্তর জুড়ে।
সাধারণত গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে এমন একটি নিদাঘই আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিকল্পনা বৈশাখের এই চিরপরিচিত রূপকে অবলম্বন করেই তার নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে ‘বৈশাখ’ কবিতায় সৃষ্টি করেছে গ্রীষ্মের ব্যক্তিগত রূপ, মন এবং মেজাজ। বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির চরিত্রে বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব আরোপন তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাতে মূর্ত হয়ে উঠলেও এই কবিতায় সেই আবেদন একেবারেই অন্যরকম।
মানবজীবনের সঙ্গে প্রকৃতিকে একাকার করে দেয়াও রবীন্দ্ররচনার অজস্র নিসর্গভিত্তিক কবিতার একটি সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব। কিন্তু তারপরও এই কথা বলা চলে, শব্দ ব্যবহারের অপরূপ তাৎপর্যে বৈশাখের প্রকৃতি কেবল ব্যক্তিত্বের ছায়া হয়ে নয়, এই কবিতায় একেবারে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে সর্বত্যাগী শশ্মানচারী, তেজোদীপ্ত মহাযোগী রুদ্রনাথের মতো। যিনি জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার প্রতি একান্ত ভ্রুক্ষেপহীন।
নিরাসক্তির নিষ্ঠুরতাই যাঁর স্বভাবধর্ম। কিন্তু তবুও তিনি নতুন সৃষ্টির অমরাবতীতে কল্যাণদূত। ‘বৈশাখ’ কবিতায় গ্রীষ্মের প্রখরদীপ্ত প্রকৃতির চরিত্রে চিরন্তন সন্ন্যাসীর এই চেহারাকেই প্রত্যক্ষরূপ দান করেছেন শব্দ প্রয়োগের অসাধারণ সার্থকতায়। এই কবিতায় দাবদাহ বৈশাখ জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে ধূলিধূসরিত গেরুয়া বসন উড়িয়ে, জলহীন নদীর তীরে তীরে, পথে পথে, শস্যশূন্য তৃষ্ণার্ত মাঠের মাঝ দিয়ে রুদ্র সন্ন্যাসীর বেশে যখন উদার উদাসভাবে ছুটে যায় কাল বৈশাখীর ভয়াবহ রূপ ধরে, তখন তার উন্মত্ত পদক্ষেপের পদধ্বনি যেন আমাদের কানেও ভেসে আসে। এই কবিতা পড়তে গিয়ে প্রচণ্ড ঝড়ের উগ্রবেগ স্পর্শ করে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে। পাঠক স্পষ্ট দেখতে পান, হঠাৎ মধ্যদিনের নীরবতা ছিন্ন করে ব্যক্তিমানুষের মতোই স্পষ্ট অবয়ব নিয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে কাল বৈশাখী। আকাশের বহ্নিদীপ্ত বিদ্যুৎরেখা সশব্দে উপড়ে পড়ছে মহাদেবের ভয়াল, বিষম বিষাণের মতো।
কবি তাই বৈশাখের প্রমত্ত হয়ে ছুটে চলার মাঝখানে যখন তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চান –
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধূলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল, তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল কারে দাও ডাক – হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?
তখন আমাদের কল্পনার মানসচোখ ক্রমাগত এক পার্থিব সন্ন্যাসীকেই প্রত্যক্ষ করে। অথচ এই ভৈরব কোনো রক্তমাংসের প্রাণময় দেহের নয়। সে জড়প্রকৃতির একটি চেতনময় রপকল্পনা মাত্র। মহাকবি যাকে মহাকাল মহেন্দ্রর সঙ্গে তুলনা করে তার মুখে তুলে দিয়েছেন ভয়াল বিষাণ। যে বিষাণ বাজিয়ে ধ্বংসের উৎসবে মত্ত হয়ে নতুন সৃষ্টির উল্লাসে মহাযোগী ভোলানাথের মতোই মেতে উঠতে চাইছে প্রলয় নাচনের ধ্বংস নেশায়। তাণ্ডব নৃত্যের ছন্দে ছন্দে ছিঁড়ে ফেলছে পুরনো সৃষ্টির গ্লানিকে। সূর্যের উত্তাপ ধারণ করে দীর্ঘ তপস্যার কৃচ্ছ্রসাধনে তার রুক্ষ ক্ষীণ শরীর হয়ে উঠেছে তেজোময়। বৃষ্টিহীন খরতাপের ঊষরতায় রক্তিম তার দেহ। আর ঝড়ের বেগে উড়ে চলেছে পিঙ্গল জটাজাল।
উপমা-রূপকের অনন্য মহিমায়, অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্জনার রসঘনতায় গ্রীষ্মের শুষ্ক তপ্ত চেহারায় মানবমূর্তি স্থাপন করে, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কারুকাজ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। যা পড়তে পড়তে কল্পনা বাস্তবের সীমারেখা ছাড়িয়ে পাঠকের মন কেবলই চলে যায় ক্লান্তিহীন শীর্ণ সন্ন্যাসীর পথরেখা লক্ষ্য করে। কিন্তু শব্দের সমাহারে মূর্তি কেবল প্রাণ প্রতিষ্ঠাই নয়, রুদ্র সন্ন্যাসীর নির্মোহ নিরাসক্ত চরিত্রকেও দৃশ্যযোগ্য ছবির মতোই ‘বৈশাখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ মহিমায়। অমিত শক্তির তেজ বিচ্ছুরণ, যুক্তব্যঞ্জনের শব্দ ঘর্ষণে যেমন জ্বলে উঠতে চেয়েছে কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে, তেমনি রবির তপ্ত দহনে অগ্নিময় হয়ে উঠেছে চারদিক। মনে হয়, লোলুপ চিতার আগুনই যেন ছড়িয়ে পড়েছে চরাচর পরিব্যাপ্ত করে। যে চিতাগ্নির ভষ্ম মেখে দীপ্তচক্ষু মহাকাল শিব, তাঁর ভয়াল বিষাণ বাজিয়ে মত্ত হয়ে ওঠেন প্রলয় নাচনের ছন্দে। যে চিতাগ্নি শিখার স্পর্শ লেগে জ্বলে যায় জীবন জগতের সব রকম প্রাচীন জীর্ণতা –
জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার লোলুপ চিতাগ্নিশিখা লেহি লেহি বিরাট অম্বর- নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তূপ বিগত বৎসর করি ভষ্মসার – চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।
তবে ‘বৈশাখ’ রবীন্দ্রনাথের এমন একটি কবিতা যেখানে কেবল বৈশাখের রুদ্র প্রকৃতি কিংবা রূপের বর্ণনা নয়, গভীর মননশীলতায় কবি জগৎ ও জীবনের এক অতলস্পর্শ তাত্ত্বিক সত্যকে মহাকাল রুদ্রের প্রতীকে উদঘাটন করতে চেয়েছেন। এই সত্য হলো, জগৎ নিত্যকাল ধরে জাগতিক সব পুরাতনকেই পেছনে ফেলে ক্রমাগত নতুনকে আনন্দের অনুভূতিতে আহ্বান করে ফিরছে। প্রাচীনকে, পুরাতনকে মায়ামোহ বন্ধনে আঁকড়ে থাকলে মানবজীবনে কেবলই জমে উঠবে জরা, অশুচি আর চিন্তা চেতনায় বদ্ধতার নিষ্ফলতা।
কিন্তু বিশ্বসৃষ্টির অংশ হিসেবে মানবজীবন প্রবাহের রুদ্ধ হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। স্রোতস্বিণী চঞ্চলা নদীর মতো প্রবাহমানতাই জীবনের একমাত্র সত্য। তাতেই আসে জগতের কল্যাণ। শুধু গ্রহণ নয়, নয় কেবল সঞ্চয়। মোহমুক্ত হয়ে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো ত্যাগ করারও প্রয়োজন রয়েছে জীবনে। কারণ জগৎ সৃষ্টির সবখানেই গ্রহণ এবং বর্জন এই দ্বৈত নিয়মের আইন। ভাঙা এবং গড়া সৃষ্টির দুই বিশিষ্ট নিয়ম। কিন্তু ধ্বংস আর সৃষ্টি পরস্পরবিরোধী নয়, জগতের বিচিত্র লীলার মধ্যে নিয়তই তারা যুক্ত হয়ে আছে। কবি তাই বলেছেন –
হে বৈরাগী, করো শান্তি পাঠ উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে – যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে পূর্ণ করি মাঠ- হে বৈরাগী, করো শান্তি পাঠ।
হে বৈরাগী বৈশাখ, তোমার নিরাসক্ত স্বভাবের রুদ্রতাকে বৈরাগ্যের আবরণ দিয়ে ঊর্ধ্বতল আকাশ থেকে নিম্নে ধরণীতলের সবখানে, এমনকি নর-নারীর হৃদয় পর্যন্ত বিস্তৃত করে দাও। তারপরে সবকিছু ধ্বংসের আনন্দ নৃত্যে লণ্ডভণ্ড করতে করতে কল্যাণের শান্তিমন্ত্র পাঠ করো। কারণ অন্তরের শান্তিমন্ত্রে ধ্বংসের মধ্যে জগৎ জুড়ে নতুন সৃষ্টির আবহ জাগে। নতুন চেতনার স্পর্শ লাগায় নতুন সৃষ্টির অলকাপুরী হয়ে ওঠে আমাদের চির পরিচিত ধরণী। পুরাতনের মধ্যে চির নতুনের সুর বারংবার বাজিয়ে তোলা তাই চিরন্তন সন্ন্যাসী ভোলানাথের কাজ। কারণ জগতে যারা ত্যাগ করতে জানে, নতুনের আহ্বান তারাই কেবল শুনতে পায় নিত্যকাল। কাল বৈশাখীর ধ্বংসলীলা এই ত্যাগের প্রতীক। তাই সে বয়ে আনে নববর্ষার সুনির্মল বারিধারা। সে বারিধারায় জগতে জরা, অশুচির অবসান ঘটে। নতুন করে বিকশিত হয় আরেক নতুন সৃষ্টি। বৈশাখ তাই মহেশ্বর শিবের মতোই কল্যাণের নিত্য দূত। ধ্বংসের মধ্যেও কবি তাই তার কণ্ঠে শুনতে পান শান্তির কল্যাণমন্ত্র পাঠ।
বৈশাখের চেহারা এবং চরিত্রকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কল্পনা মনীষা যেভাবে পরিস্ফূট হয়েছে এই কবিতায়, এক কথায় অনবদ্য তার চিত্রকল্প। অনবদ্য, তত্ত্বের গভীরতায়। কাব্যের নির্মল সুষমায়। শিল্প সৌকর্ষে এবং দাশর্নিক ভাবনায়। ‘বৈশাখ’ সাহিত্য জগতের এক চিরন্তন সম্পদ।
মন্তব্য চালু নেই