যে তারা পথ চেনায়

নার্সারির ইংরেজি বইতে পরিচিত একটা ছড়া আছে। ছড়াটি হলো ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার/হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর’। কিন্তু যুগ বদলেছে। প্রযুক্তির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ছোটবেলার আবেগ অনুভূতিগুলো।

জীবন আজ বড় যান্ত্রিক। প্রযুক্তির রঙিন দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে দূর আকাশের তারাগুলো। এখন আর চৈতালি পূর্ণিমার রাতে মায়ের কোলে বসে চাঁদ-তারাদের রূপকথা শোনে না ছেলেমেয়েরা। অথচ আমাদের পূর্বপূরুষরা কি বিষ্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখত তারাগুলো। একটি একটি তারা যোগ করে তাদের ভালবাসার মানুষের ছবি আঁকত কল্পনার রঙ ঢেলে। বাহারি সব নাম দিত সেসব তারাদের। সেই নামেই পরিচিত হয়ে উঠত তারাগুলো। জ্যোতিষশাস্ত্রের জন্মই হয়েছে তারা দেখে দেখে। যদিও জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়।

মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক এমনকি হিন্দুপুরাণের বেশিরভাগ দেবদেবীর নাম এসেছে আকাশের ওই তারাদের থেকেই। তৈরি হয়েছে কতশত উপাখ্যান। কিন্তু অতশত উপাখ্যান নয়, আজ আমরা ধ্রুবতারার গল্প শুনব। যুগ যুগ ধরে এই তারাটিই অভিযাত্রিকদের পথ চিনিয়েছে। গহীন সমুদ্রে দিশাহারা নাবিকের দিক পাইয়ে দিয়েছে।

ইংরেজিতে একে বলে ‘নর্থ স্টার’। কেউ বলে পোলস্টার। ধ্রুবতারাকে সবসময় নিশ্চল বলে মনে হয়। একে সবসময় দেখা যায় উত্তর মেরুর আকাশে । মনে হয় বুঝি ধ্রুবতারাই আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম তারা। কিন্তু পৃথিবী থেকে যত তারা দেখা যায়, তার মধ্যে ধ্রুবতারা ঔজ্জ্বল্যের দিক থেকে ৫০তম। ধ্রবতারা উত্তরমেরুর মেরুবিন্দুর সাথে একেবারে সমান্তরালে অবস্থান করে। তাই একে মনে হয় সবসময় একই জায়গায় স্থির। এজন্যই এর নাম ধ্রুবতারা।

2016_04_19_16_23_34_owJla95h48ASXYDwQ5LhXiACvXa6bB_original

তবে ধ্রুবতারা কিন্তু শুরু থেকেই দিকনির্দেশক তারা হিসেবে ছিল না। ভবিষ্যতেও এমন এক দিন হয়তো আসবে সেদিন এটা দিক নির্দেশক থাকবে না। মিশরীয়রা যখন পিরামিড তৈরি করত তখন আরেকটা তারাকে দিকনির্দেশক হিসেবে দেখা হত। সেটা হলো ‘থাবন’। অনেক পরে এসেছে আমাদের এই ধ্রুবতারা।

থাবন কে বাদ দিয়ে একে কেন বাছা হলো? এর উজ্জ্বলতা অনেক বেশি। অবস্থান অনেক নিখুঁত। আগের দিনে ইউরোপিয়ান নাগরিকরা ধ্রুবতারার সাহায্যে দিক নির্ণয় করে মহাসাগর পাড়ি দিত। মরুভূমি, গহীন জঙ্গলে পথ হারানো অভিযাত্রীদেরও পথের দিশা দিত ধ্রুবতারা। প্রাচীন সভ্যতার মানুষ বিশ্বাস করত, তাদের জীবন জীবিকা, ভাগ্য নির্ভর করে কতগুলো তারার ওপর। ধ্রুবতারা তাদের মধ্যে অন্যতম। দাসপ্রথার যুগে আমেরিকার দাসেরা মনে করত ধ্রুবতারাই একদিন তাদের মুক্তির পথ দেখাবে।

ধ্রুবতারাকে কেন্দ্র করে উত্তর মেরু অঞ্চলের তারাগুলো তাদের দিক পরিবর্তিত হয়। আক্ষরিক অর্থেই ধ্রুবতারা উত্তর দিক নির্দেশ করে। ধরুন, আপনি মরুভূমিতে পথ হারিয়েছেন। অনেক রাত। দিক ঠিক করতে পারছেন না। তাহলে ধ্রুবতারার দিকে মুখ করে দাঁড়ান। দুই হাত প্রসারিত করুন। তাহলে আপনার ডান হাত পূর্বদিক, বামহাত পশ্চিম দিক আর আপনার পিঠ দক্ষিণ দিক নির্দেশ করবে।

ধ্রুবতারা কিন্তু কোন একক তারা নয়। আসলে এরা তিনিটি তারার গুচ্ছ। এরা একটি সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারপাশে আবর্তন করে। এদের একটির নাম পোলারিস-এ। এর ভর সূর্যের ছয়গুণ। অন্য দুটি তারা হলো পোলারিস-এবি এবং পোলারিস-বি। পোলারিশি-এবি বিলিয়ন মাইল দূর থেকে পোলারিস-এ কে আবর্তন করে। অন্যদিকে পোলারিশ-বি ২৪০ বিলিয়ন মাইল দূর থেকে পোলারিস-এ কে আবর্তন করে।

এখন হয়তো ধ্রুবতারার সেই গুরুত্ব নেই। বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু ধ্রুবতারা তারা যুগে যুগে মানুষের পথের দিশা হয়ে আজকের এই আধুনিক পৃথিবী গড়তে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

লেখক: রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং’ (ইইই) বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।



মন্তব্য চালু নেই