যে কারণে জোট ছাড়ল ইসলামী ঐক্যজোট

জোটের যেকোনো বিষয়ে বিএনপির একক সিদ্ধান্ত এবং শরিকরা ‘মূল্যায়ন না পাওয়ায়’ সৃষ্ট অসন্তোষের জেরে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে ইসলামী ঐক্যজোট।

তবে জোটের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের কারণ উল্লেখ না করলেও দলটির চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেছেন, ‘ইসলামী ঐক্যজোটের স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেদের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনযোগী হবে দলটি। কারণ আদর্শগত দিক থেকে ইসলামী ঐক্যজোট একটি স্বতন্ত্র সংগঠন। তাই এখন থেকে স্বকীয়তা বজায় রেখে জোটের কর্মতৎপরতা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।’

ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩শ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথাও জানান তিনি।

জোটের একটি সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকা এই দলটির চরম ক্ষুব্ধ হয় পৌর নির্বাচনে প্রার্থী দিতে না পেরে। ওই নির্বাচনে কয়েকটি পৌরসভায় প্রার্থী দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল দলটি। কিন্তু প্রয়াত কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি এবং কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের দল এলডিপিকে ছাড় দিলেও জোটের অন্য শরিকদের তা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা প্রচ- ক্ষুদ্ধ হয় বিএনপির হাইকমান্ডের প্রতি। ওই সময়েই মূলত জোট থেকে বেরিয়ে আসার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার জোটের কোনো নেতাকে না রেখে বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচি জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ওই সিদ্ধান্তকে আরো ‘যৌক্তিক’ করে তোলে বলে মনে করেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে দলের ত্রিবার্ষিক জাতীয় কনভেনশনে এই ঘোষণা দেন ইসলামী ঐক্যজোটের পুনঃনির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী।

সম্পর্কের টানাপড়েনে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া দলের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট তৃতীয় দল। এর আগে সম্পর্কে টানাপোড়েনে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে ন্যাপ-ভাসানীর একাংশ।

১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট এবং বাংলাদেশ জাতীয় পাটি-বিজেপির সমন্বয়ে চারদলীয় জোট গঠন করা হয়।

পরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে ১৮ দলীয় জোট হয়। এরপর ২০ দলীয় জোটে রূপ নেয়।

২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে ৮টি দলের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। এসব দলের কয়েকটি ‘সাইনবোর্ড বা নামসর্বস্ব’। ভাঙন আর দলাদলিতে জড়িয়ে পড়া এসব দলকে জোটে সম্পৃক্ত করায় বিএনপির ভেতরে যেমন অস্বস্তি আছে, তেমনি অসন্তোষ রয়েছে জোটের উল্লেখযোগ্য শরিকদের মধ্যে।

জোটের অপর একটি সূত্র জানায়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোটের ইসলামী দলগুলোর বিপরীতে ধীরে চলো নীতিতে কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি। বিষয়টি খুব ভালো চোখে দেখেনি ধর্মভিত্তিক দুটি দল জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোট। কোনো এক বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা এই জোট নেতাদের বলেছিলেন, ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছে বিএনপি। এ নিয়ে তখন জোটের সম্পর্কে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচিতে জোটের কোনো নেতাকে রাখা হয়নি। দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি এবং তাতে শরিকদের না রাখায় এ নিয়ে হিসেব-নিকেশও কষতে শুরু করে জোটের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা মনে করেন তাদের এড়িয়ে যেতেই বিএনপি এককভাবে ওই সমাবেশের আয়োজন করেছে।

বৃৃহস্পতিবার কনভেনশনের মধ্য দিয়ে যে ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেবেন তা এক প্রকার টেরও পেয়েছিলেন শরিকরা। কারণ এর আগে কোনো শরিক দলের যেকোনো অনুষ্ঠানে বিএনপি এবং অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোটের বৃহস্পতিবারের কনভেনশনে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

জানতে চাইলে জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, রাজনীতিতে ভাঙা গড়ার খেলা চলবেই। কেউ বের হয়ে যেতেই পারে, আবার কেউ নতুন করে যুক্ত হতে পারে। এটি নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কারণ নেই। বিএনপি জোটকে আরো শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই জোট নেতা।

জোটের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ইসলামী ঐক্যজোটের ২০ দলীয় জোট ছাড়ার নেপথ্যে অনেক কারণ আছে। চাপে পড়েও তারা এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ সরকার ২০ দলীয় জোট ভাঙার অনেক ষড়যন্ত্র করছে। ইসলামী ঐক্যজোটের বেরিয়ে যাওয়ার জোটের কোনো ক্ষতি হবে না। এর আগেও শেখ শওকত হোসেন নিলু জোঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এতে জোটের কোনো ক্ষতি হয়নি।

তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে জোটে থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত ইসলামী ঐক্যজোট নিতেই পারেন বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, শরিকদলগুলোর সঙ্গে বিএনপির যে জোট তা আদর্শিক। আন্দোলনের জন্য এই জোট গঠন করা হয়েছিল। এখন কেউ যদি মনে করে জোটে থাকবে না, তাহলে কী করা যাবে? তবে এতে জোটে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ বিএনপির অনেক বড় রাজনৈতিক দল।

মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা হয়তো দলের শেষ কথা নয়। ওই দলের আরো নেতা আছেন, যারা হয়তো পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারেন।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই