যেভাবে শুরু রাজন হত্যার মূল ঘটনা
সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশের মানুষ স্তম্ভিত। সাধারণ মানুষ বিচারের দাবিতে মাঠে নেমেছেন। আর অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন বিচারহীনতা এবং অসুস্থ সমাজের পরিণতি হল এই নির্মমতা।
গত বুধবার সকালে সিলেটের জালালাবাদ এলাকায় চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ১৩ বছরের রাজনকে। নির্যাতনকারীরা শিশুটিকে পেটানোর ২৮ মিনিটের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। সেই ভিডিও দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
রাজনের মা লুবনা বেগম জানান, তার স্বামী শেখ আজিজুর রহমান ওইদিন বাড়িতে ছিলেন না। দুই পুত্রকে নিয়ে বাড়িতে শুধু তিনিই। ঘরেও খাবার চাল ফুরিয়ে গেছে। তখন ছেলে রাজনকে সবজি দিয়ে সেগুলো বিক্রি করার জন্য টুকেরবাজারে পাঠান।
এখানে প্রতিদিনই ফজরের পর সবজি বাজার বসে। স্থানীয়রা নিজেদের ক্ষেতের সবজি এনে এখানে বিক্রি করেন। রাজনকেও তার মা নিজেদের ক্ষেত থেকে কিছু সবজি দিয়ে বাজারে পাঠান। বলে দেন, সবজি বেচে যা পাও, তা দিয়েই যেন চাল কিনে আনে। মা ও ছোট ভাইয়ের জন্য সবজি বিক্রি করে চাল কিনতে গিয়েই নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারাল তেরো বছরের রাজন।
গত বুধবার কুমারগাঁও বাসস্টেশন সংলগ্ন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে ১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজনকে চুরির অপবাদ দিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
হত্যার পর তার মরদেহ মাইক্রোবাসে করে কুমারগাঁও গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি খালি মাঠে মরদেহটি রাখার সময় স্থানীয় লোকজনের কাছে বিষয়টি ধরা পড়ে। তারা মরদেহ রাখতে যাওয়া কয়েকজনকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে জনতা মুহিত আলম নামে একজনকে আটক করলেও পালিয়ে যায় অন্যরা।
অপরাধ বিজ্ঞানীর প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, সমাজে বিচারহীনতা এবং অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ এই নির্মম শিশু নির্যাতন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শেকড় গেঁড়ে বসায় একটি শিশুকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে তারা সাহস পেয়েছে।
তিনি বলেন, যারা এই কাজ করেছে তারা ভয়ংকর বিকৃত মানসিকতার। তবে তাদের এই কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের অসুস্থ সমাজের চেহারা বেরিয়ে এসেছে। শিশুদের প্রতি সমাজ যে দরদি নয় তারই প্রকাশ ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, আমাদের দেশের আইনে ৯ বছর পর্যন্ত শিশুরা কোনো অপরাধ করে বলে গণ্য করা হয় না। আর ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা অপরাধ করে না, ভুল করে। কিন্তু আইনের এই কথা হৃদয়ে নেই। ফলে এই নির্মমতা ঘটেছে।
মানবাধিকার কর্মীর দৃষ্টিতে
মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই বর্বরতা সীমাহীন। শিশুর প্রতি সহিংসতার জন্য আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই দায়ী। তিনি বলেন, শিশুটিকে বুধবার প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় অনেক লোকের সামনে। আর তা ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠলে চারদিন পর রোববার পুলিশ তৎপর হয়। আমার প্রশ্ন, প্রকাশ্যে ঘটা এই নির্মমতার খবর কী তখন পুলিশের কাছে পৌঁছায়নি? নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। তাহলে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন?
এলিনা খান বলেন, আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরেই নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বীজ লুকানো রয়েছে। নির্যাতনকারীরাই নির্যাতনের ভিডিও করেছে। এটা প্রমাণ করে এই দেশে অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের মত
এদিকে শুধুমাত্র নির্মমভাবে শিশু নির্যাতনের এই ঘটনাই নয়, এর আগে দুই নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতনের ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য ও ছবি ধরেই মূলধারার সংবাদমাধ্যম ছবি ও খবর প্রকাশ করে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, এর দুটো দিক আছে। একটা হলো অপরাধীরাই এসব ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে তাদের ক্ষমতা দেখাতে চায়। আবার সাধারণ মানুষই এসব অপরাধের ছবি তুলে বিচারের আশায় তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়। মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের প্রসার এটাকে সহজ করেছে। তবে এই ফুটেজ ও ছবি প্রকাশে কোনো নীতিমালা মানতে চান না সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
তিনি বলেন, তবে ইতিবাচক দিক হলো মানুষ আর মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের অপেক্ষা করছেনা। তারা তাৎক্ষণিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেই সম্প্রচার কর্মী হয়ে উঠছে। ফলে এখন আর অনেক অপরাধের ঘটনাই চাপা রাখা যায়না।
এ সংক্রান্ত আরো সংবাদের লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
মন্তব্য চালু নেই