যেভাবে ছিটমহল সমস্যা তৈরি হয়েছিল ভারত-বাংলাদেশের

গত ৬ মে ভারতের রাজ্যসভায় পাশ হয় সীমান্ত বিল। ৭ মে লোকসভায়ও সেটি পাশ হয়। অবাক করা বিষয় হল দু’জায়গাতেই সর্বসম্মতভাবে বিলটি পাশ হয়। এটিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা বলতেই হবে। তবে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যে সীমানা ছিল সেটিই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সীমানা।

তবে এত বছর পরে এসেও কেন আবার সীমানা নিয়ে দু’দেশের টানাটানি? সেটি বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে কিছু জটিল ভৌগলিক বিভক্তি যা ছিটমহল নামে পরিচিত। কেন এই ছিটমহলের সৃষ্টি?969347_10151595458093670_8408186_n

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের গর্ব ও অন্যতম সেরা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রাগিব হাসানের ফেসবুকের একটি নোটকে আমরা পাঠকদের জানাতে চাই। যেখানে আপনারা ছিটমহল, সেখানকার মানুষের দূর্ভোগ, কেন সৃষ্টি হয়েছিল ও কেন সমাধান দরকার তা জানতে পারবেন। জনাব রাগিব হাসান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সেই নোটটি নীচে হুবুহু উল্লেখ করা হল। এটি মে ৩১, ২০১৩ তে ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছিল।

ছিটগ্রস্থ ছিটমহল – বাংলাদেশের ভিতরে ভারত, তার ভিতরে বাংলাদেশ, তার ভিতরে ভারত!!

==ছিটগ্রস্থ ছিটমহল – ও পাশা খেলার বিপদ – রাগিব হাসান==

ছিটমহল বা enclave হলো এক দেশের মধ্যে অন্য দেশের পুরাপুরি ঢুকে থাকা অংশ। খুব বিখ্যাত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলের নামটা অনেকেরই জানা – এই ছিটমহলটি বাংলাদেশের, কিন্তু এর চারিদিকে ভারতের এলাকা। ফলে এখানে থাকা লোকজন কার্যত জেলখানাতেই বন্দী। বহু দিন পর “দয়া” করে ভারত ৩ বিঘা করিডোর দিয়েছে আমাদের চুক্তিমতো, তবে তাতেও আছে বিস্তর ঘাপলা।

কিন্তু এটাই একমাত্র ছিটমহল না, বরং এরকম বহু ছিটমহল রয়েছে। ভারতের অংশ বাংলাদেশের ভিতরে, বাংলাদেশেরটা ভারতের ভিতরে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো এই ছিটমহলের ইতিহাসটা কী? একটা ব্যাপারে খুব ভালো মিল আছে – এই ছিটমহলগুলার অধিকাংশই প্রাচীন কুচবিহার রাজ্যের অংশ ছিলো। আর অনেকটা মোগল আমল থেকেই এই এলাকাগুলোর এই অবস্থা। জনশ্রুতি আছে, সেসময়ে কুচবিহার রাজ্যের রাজা, আর রঙপুর রাজ্যের রাজার মধ্যে পাশা খেলায় বাজির পুরস্কার হিসাবে এই এলাকাগুলা আদান প্রদান হতো। ফলে কুচবিহার রাজ্যের অংশ হয়ে পড়ে এমন অনেক এলাকা যা আসলে রঙপুরে, আর উল্টোটাও।

১৯৪৭ এ ব্রিটিশরা চলে যাবার সময়েই বাধলো গণ্ডগোল। রঙপুর পেলো পূর্বপাকিস্তান, আর কুচবিহার পেলো ভারত। কিন্তু এই মহলগুলো? সেগুলো নিয়ে দুই দেশই সমস্যায় পড়লো যা এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে ভারতের ১০৬টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভিতরে, আর বাংলাদেশের ৭১টি ছিটমহল পড়েছে ভারতের ভিতরে।

বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের ছিটমহল। ভারত কমলা, বাংলাদেশ সবজেটে-নীল রঙের। ছিটমহলগুলাও একই ভাবে চিহ্নিত।বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের ছিটমহল। ভারত কমলা, বাংলাদেশ সবজেটে-নীল রঙের। ছিটমহলগুলাও একই ভাবে চিহ্নিত।

এর মধ্যে আরো অদ্ভুত সব ব্যাপারও আছে। ভারতের ভিতরে থাকা ২১টি বাংলাদেশী ছিটমহলের ভিতরে আবার ভারতের ছিটমহল আছে। মানে বাংলাদেশী এসব ছিটমহলের চারিদিকে ভারত, আবার ভিতরের কেন্দ্রের দিকে ভারতের এলাকা। বাংলাদেশের ভিতরে এরকম রয়েছে ৩টি ভারতীয় ছিটমহল, যাদের ভিতরে আছে বাংলাদেশ।

আর সবচেয়ে উদ্ভট ব্যাপার? দহলা-খাগড়াবাড়ি নামের ছিটমহল। এটা ভারতের একটা ছিটমহল যার চারিদিকে আছে বাংলাদেশের উপানচৌকি গ্রামের ভিতরে পড়েছে। আবার বাংলাদেশের উপানচৌকি গ্রামটি পড়েছে ভারতের বলপাড়া খাগড়াবাড়ি গ্রামের ভিতরে, মানে এটাও ছিটমহল। এবং পুরা ব্যাপারটাকে আরো গোলমেলে করে দিতে গিয়ে বলপাড়া গ্রামটি নিজেও একটা ছিটমহল, মানে এর চারিদিকে বাংলাদেশ।

954631_10151595459378670_867404666_n

দহলা-খাগড়াবাড়ি ছিটমহল, ভারতের এই এলাকাটি বাংলাদেশের ভিতরে, তা আবার ভারতের ভিতরে, এবং সবার চারিদিকে আবার বাংলাদেশ!!দহলা-খাগড়াবাড়ি ছিটমহল, ভারতের এই এলাকাটি বাংলাদেশের ভিতরে, তা আবার ভারতের ভিতরে, এবং সবার চারিদিকে আবার বাংলাদেশ!!

ব্যাপারটা কী দাড়ালো? বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের অংশ, তার ভিতরে বাংলাদেশের অংশ, আর তার ভিতরে ভারতের অংশ। মানে যদি রঙ্পুর থেকে রওনা হন, প্রথমে একবার বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পেরুতে হবে, তার পর ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত, আর সবশেষে ৩য় বারের মতো বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকলে তবেই পৌছাতে পারবেন দহলা-খাগড়াবাড়িতে।

অনুসিদ্ধান্ত – পাশা খেলা বড়ই বিপদজনক। মাথায় প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

(নোট – ম্যাপগুলো উইকিপিডিয়া হতে মুক্ত লাইসেন্সের অধীনে নেয়া)।



মন্তব্য চালু নেই