যুবলীগের নেতার কয়লাভাটায় বিপন্ন পরিবেশ, স্বাস্থ্য-ঝুঁকি

সরকারি নির্দেশ অনুসারে, বরিশাল অঞ্চলে কয়লাভাটা নির্মাণের অনুমোদন নেই। সে নির্দেশ উপেক্ষা করে তিনি নির্মাণ করেছেন কয়লাভাটা। যেখানে কয়লা তৈরি চলছে, সে জায়গাও নিজের নয়। সরকারি সম্পত্তি। সরকারি ওয়াক্ফ এস্টেটের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের দেড় একরের বেশি জমি দখল করে ইটভাটা গড়ে তুলেছেন তিনি। গত বছর এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ১৫ দিন ওই কয়লাভাটার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন পুরোদমে তা চলছে। বরং এর বিস্তৃতি ঘটেছে।খবর প্রথম আলো’র।

এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তেমনি উজাড় হচ্ছে গাছ, দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি।

কয়লাভাটাটির মালিক মিজানুর রহমান ওরফে মিজান মোল্লা (৩৫) পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। কালাইয়া বন্দর এলাকায় আলী আকবর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অদূরে দক্ষিণ পাশে প্রায় দুই বছর আগে সরকারি ওয়াক্ফ এস্টেটের (আবদুল হক ওয়াক্ফ এস্টেট ইসি নম্বর-২১৭৯) ৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের ১ একর ৫৭ শতাংশ জমি দখল করে তিনি কয়লাভাটা নির্মাণ করেছেন।

ভাটাটিতে হাজার হাজার মণ গাছ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কয়লা। এতে একদিকে যেমন গাছ সাবাড় হচ্ছে, তেমনি গাছ পোড়ানোর কালো ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। এ কারণে স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে আছে ওই এলাকার নারী, শিশুসহ হাজারো মানুষ। এ নিয়ে অভিযোগ করা হলেও তা বন্ধ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিয়মানুযায়ী, ফসলি জমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোনো ইটভাটা করা যাবে না, পোড়ানো যাবে না কাঠ। আর সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী বরিশাল অঞ্চলে কোনোভাবেই কয়লাভাটা নির্মাণ করার অনুমতি দেওয়াও যাবে না।

সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে সে কাজটিই দুই বছরের বেশি সময় ধরে করছেন যুবলীগের নেতা মিজান মোল্লা।

পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশালের বিভাগীয় পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ পুড়িয়ে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা তৈরি করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এমনটি হয়ে থাকলে তা পরিবেশের জন্যও ভয়াবহ হুমকি। এদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে (বরিশাল বিভাগে) কয়লাভাটা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।’

যুবলীগের নেতা মিজান মোল্লা দাবি করেন, শাহজাদা মিয়া নামের এক মোতোয়ালির কাছ থেকে ওই জমি তিনি লিজ নিয়েছেন।

কিন্তু কয়লাভাটা করার কোনো অনুমতি আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো অনুমতি নেই। তবে অনুমতি পাওয়ার জন্য কাগজ জমা দিয়েছি।’ এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না বলে তিনি দাবি করেন।

বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শাহজাদা মিয়া নামে ওই ওয়াক্ফ এস্টেটের কোনো মোতোয়ালি নেই। বর্তমান মোতোয়ালির দায়িত্বে আছেন মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মিয়া ও সোলায়মান মিয়া। নিয়মানুযায়ী ওয়াক্ফ এস্টেটের কোনো জমি লিজ দেওয়ার আগে ওয়াক্ফ প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। সে রকম কোনো অনমুতিও ওই এস্টেটের মোতোয়ালিদের দেওয়া হয়নি। আর ইট কিংবা কয়লাভাটা করার অনুমতি তাঁরা (ওয়াক্ফ প্রশাসক) দিতে পারেন না। বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে।

মোতোয়ালি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মিয়া বলেন, ‘কাউকে এস্টেটের কোনো জমি লিজ দেওয়া হয়নি। ওই জমির সম্মুখভাগে নির্মাণ করা তাঁদের কয়েকটি দোকানঘর জোরপূর্বক ভেঙে ওই জমি দখল করে নিয়েছেন মিজান মোল্লা।’

উপজেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ভাটায় কাঠ পোড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি।’

ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে যিনি জমি নিবন্ধন করে দিয়েছেন, সেই আবদুল হকের নাতি মো. মোহসেন মিয়া (৪৮) অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর তিনিসহ আরও দুই ওয়ারিশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) বিভিন্ন দপ্তরে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ইউএনও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, ‘যখন অভিযোগ করা হয়েছিল, তখন আমি এই কর্মস্থলে ছিলাম না। আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে এ ব্যাপারে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ‘সরকারি জমিতে যুবলীগ নেতার কয়লা ভাটা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ১৫ দিন ওই কয়লা ভাটাটিতে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরপর আবার শুরু হয়। বর্তমানে কয়লা ভাটাটির বিস্তৃতি আরও বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, আলী আকবর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ৪০ মিটার দক্ষিণে, কালাইয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কালাইয়া রব্বানিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে থেকে ১০০ মিটার পশ্চিম-দক্ষিণে, কালাইয়া ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৫০ মিটার পশ্চিমে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওই কয়লাভাটাটি নির্মাণ করা হয়েছে।

শ্রমিকেরা জানান, দুই বছরের বেশি সময় ধরে গাছ পুড়ে ওই স্থানে কয়লা উৎপাদন চলছে। এ জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছয়টি চুলা। প্রতিটি চুলায় একসঙ্গে ৩০০ মণ কাঠ দেওয়া হয়। ১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর প্রতি চুলা থেকে প্রায় ৭০ মণ কয়লা বের করা হয়। ছয়টি চুলায় প্রতি মাসে প্রায় ৫৪ হাজার মণ গাছ পোড়ানো হয়। আর তা থেকে প্রায় ২ হাজার টন কয়লা উৎপাদন হয়। কয়লা উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মণ গাছ কেটে নিয়ে আসা হয় কারখানায়।

এতে একদিকে যেমন উজাড় হচ্ছে গাছ, তেমনি গাছ পোড়ানোর কালো ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক বলেন, জনবসতিপূর্ণ এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসংলগ্ন ও ফসলি জমিতে কয়লাভাটা নির্মাণ করে কাঠ পোড়ানোর কারণে এ এলাকার ও আশপাশের বন শিগগিরই উজাড় হয়ে যাবে। ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ফসলি জমির ফলনও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁরা আরও বলেন, বর্তমানে কয়লাভাটাটি মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পরিবেশ বিনষ্টকারী ওই কয়লাভাটাটি উচ্ছেদ করে জমি দখলমুক্ত করার দাবি জানান।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (প্রবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘এভাবে কয়লাভাটা নির্মাণ করে গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।’

একই কথা বলেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘বেলা-এর বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন। তিনি দ্রুত কয়লাভাটাটি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান।

ওই কয়লাভাটা-সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কয়লাভাটা চালু হওয়ার পর থেকেই শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে ভুগছেন অনেকে। এলাকার অনেক শিশুর রোগবালাই লেগেই রয়েছে।

বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা এ এস এম সায়েম কয়লাভাটাটিকে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে বলেন, এতে ওই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’



মন্তব্য চালু নেই