যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজার চাইলেন শেখ হাসিনা

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মার্কিন সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের ইম্পেরিয়াল হলে সে দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়ে এই আহ্বান জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ সভার আয়োজন করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানি করা পোশাক থেকে শুল্ক বাবদ যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৮৩২ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। শুল্ক ছাড়া এসব পণ্যের ছাড় দেয়া হলে একদিকে মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা যেমন লাখ লাখ ডলার বাড়তি আয় করতে পারবে তেমনি বাংলাদেশের উৎপাদকদেরও বেশি দাম দিতে পারবে। ফলে উৎপাদকরা কর্মীদের বেশি মজুরি দিতে পারবেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু টাকার অংক নয়, নজর দিতে হবে এই পরিবর্তনে মানবিক মূল্যের দিকে। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৪০ লাখ মানুষের জীবিকা, যার ৯০ ভাগই নারী।’ তৈরি পোশাক খাতে কাজের পরিবেশ মানসম্মত করতে তার সরকারের আন্তরিকতার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের কথা তুলে ধরে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন তা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী নেতাদের সামনেও তুলে ধরেন তিনি।

সাতটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসব জোনে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো জমি লিজ নিয়ে শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করতে পারছে। আমাদের ৮ কোটি যুব কর্মশক্তি রয়েছে যাদের এসব শিল্পে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আর উৎপাদিত যে কোনো পণ্যের জন্য রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের বিশাল একটি বাজার।’

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়াও জাহাজ নির্মাণ, রিসাইক্লিং, রাসয়নিক সার, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ, ঔষধশিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটজাত পণ্য, তথ্য প্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহোরণ, পর্যটন, চিকিৎসা উপকরণ, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় তিনি ক্ষমতা নেয়ার সময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় তা দাঁড়িয়েছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালের মধ্যে বিনিয়োগ ১১৭.১৪ ডলারে উন্নীত করা হয়। আর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র মোট বিনিয়োগ করে ৩৩১.৩৫ মিলিয়ন ডলার।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৪ সালের সবশেষ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। তবে গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ তার তুলনায় বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ অনেক কম। যদিও আগামী তিন বছরের মধ্যে এই বিনিয়োগের হিসাব বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।’

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মিমাংশার পর বাংলাদেশ সমুদ্রে যে জলরাশির অধিকার পেয়েছে সেখানে সমুদ্র তলদেশে জ্বালানি ও খণিজ সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। আর এই সম্পদ আহোরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর এ কাজেও অন্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও দু’টি কোম্পানি কাজ পেয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোতে বাংলাদেশ ৮ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছ থেকে ৮৩২ মিলিয়ন ডলারের শুল্ক পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বন্দরগুলো শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলে এখানকার খুচরা বিক্রেতাদের অনেক অর্থ বেঁচে যেতো। আর তাতে আমাদের দেশে যে শ্রমিকরা এই পোশাক তৈরি করছে তাদের মজুরি ও সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হতো।’ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে আরো বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

দেশে গত এক বছরে শ্রমখাতের সংস্কারগুলো তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করা হয়েছে। গত চার বছর ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত থেকে শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরি বাড়িয়েছি। একজন শিক্ষানবীষের মজুরি ২০০৯ সালে ছিল ১৬০০ টাকা, ২০১৩ সালে তা ৫৩০০ টাকা করা হয়েছে। আইএলও’র নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি নেয়া হয়েছে।’

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘কারখানাগুলোর কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য সরকার এক হাজার পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে। আইএলও-আইএফসির সহায়তায় উন্নত কর্ম-পরিবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নে সংখ্যা ১০০টি থেকে ২৩০টিতে উন্নীত করা হয়েছে।’

২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকফা চুক্তির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর মাধ্যমে দুই দেশ প্রথমবারের মতো কৌশলগত সহায়তার যুক্তিতে আবদ্ধ। গত ছয় বছরে বাংলাদেশ সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি এনেছে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের প্রমাণ এই চুক্তি।’ আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতের ইম্পেরিয়াল হলে এই কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদার, সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ ও এফবিসিসিআই’র সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদসহ স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী।



মন্তব্য চালু নেই