মেহেরপুরে গাছে বাঁধা আরেক ববিতা
ব্যস্ততম সড়কের পাশে উৎসুক জনতার ভিড়। কয়েকজন তরুণ ছুটাছুটি করে যানবাহন ও পথচারীদের কাছে সহযোগিতা চাইছেন। রাস্তার উপরে একটি প্লস্টিকের গামলায় কিছু টাকা ও কয়েন। পাশে একটি গাছের সঙ্গে বাঁধা মধ্যবয়সী এক নারী। চোখে মুখে তার আতঙ্কের ছাপ। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন এদিক-ওদিক। মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেই বিষ বিষ বলে আর্তনাদ করছেন।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দি নিশিপুরে ববিতা নামের গৃহবধূকে গত কয়েকদিন ধরে এভাবেই বেঁধে রেখে চিকিৎসার জন্য টাকা তোলা হচ্ছে।
স্বামীর বাড়িতে খাবার খেয়ে হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন গৃহবধূ ববিতা। এমন অভিযোগ তুলে তার খালা রিজিয়া বেগম জানান, তাকে পাগল বানিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সহায় সম্বল ও পিতামাতাহীন ববিতার চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
স্থানীয় সূত্রমতে, বছর চারেক আগে প্রেমের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বামুন্দি মোল্লাপাড়ার ব্যবসায়ী মিনা মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় ববিতার। বিয়ের পর থেকে বামুন্দি এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছিলেন মিনা ও ববিতা। কিছুদিন আগে ববিতাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিনার নিজ বাড়িতে। সেখানে মিনার প্রথম স্ত্রী ও বাড়ির লোকজন ববিতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এনিয়ে কয়েকদিন ববিতার ওপর মানসিক নির্যাতন চলছিল। এর এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে তার খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকেই ববিতার কোনো খোঁজ খবর নেয়নি মিনা মিয়া।
ববিতার খালা রিজিয়া আরো জানান, এতিম ববিতা তার কাছেই মানুষ। এ কারণে তাকে তাড়িয়ে দিতে পারছেন না। মিনা ও তার প্রথম স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে রিজিয়া বলেন, ববিতাকে কৌশলে মিনার বাড়ি নিয়ে পাগল বানানো হয়েছে। এখন তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু মিনা কোনো গুরুত্ব কিংবা খোঁজ খবর নিচ্ছে না। তাই পাড়ার ছেলেরা চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছে।
গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা প্রসঙ্গে রিজিয়া বলেন, শরীরের সব কাপড়-চোপড় খুলে ফেলার চেষ্টা করছে ববিতা। মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ছিল। এ কারণে চুল কেটে খাটো করা হয়েছে। হাত বেঁধে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ববিতার দুটি ছেলে সন্তান থাকলেও প্রথম স্বামীর সঙ্গে সংসার হয়নি। সংসার ভাঙার বেশ কিছুদিন পর মিনার সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু সংসার সুখ তার কপালে সইলো না। এসব কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন খালা রিজিয়া খাতুন।
এদিকে, মানসিক ভারসম্যহীন স্ত্রীর খোঁজ খবর না নেয়ায় স্বামী মিনা এলাকার মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। পথচারী অনেকেই তাকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। গৃহবধূ ববিতার এ অমানবিক পরিস্থিতির জন্য মিনাকে দায়ী করে তার শাস্তি দাবি করছেন কেউ কেউ। তবে এলাকায় খোঁজ করে মিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
নিশিপুর যুব উন্নয়ন ক্লাবের কয়েকজন সদস্য প্রতিদিনই টাকা তুলছে। ক্লাবের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান লাল্টু, আসিফ, তরিকুল, ইসলাম, শান্ত আহম্মেদ ও আহম্মেদ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টাকা তোলার দায়িত্ব পালন করছে।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান লাল্টু জানান, প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টাকা আদায় হচ্ছে। গত কয়েকদিন যা আদায় হয়েছে তা চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়। টাকা জোগাড় হলে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নেয়া হবে। অসহায় গৃহবধূর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বামুন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল জানান, বিষয়টি অমানবিক। ববিতার পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে মিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানতে চাইলে গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে ৩০ এপ্রিল সকালে নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামে ববিতা নামে এক গৃহবধূকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন চালায় তার সেনা সদস্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ ঘটনায় ৫ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সেনা সদস্য স্বামী শফিকুল শেখসহ সাত জনকে আসামি করে লোহাগড়া থানায় মামলা করেন ববিতার মা খাদিজা বেগম। এ ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় হয়।
মন্তব্য চালু নেই