মেসির স্মরণীয় ১০ মুহূর্ত

তার ১১ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে অর্জন নেহাত কম নয়। বার্সেলোনার হয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন লিওনেল মেসি। বার্সেলোনার পক্ষে সর্বোচ্চ গোল, লা লিগার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোল, লা লিগায় টানা ২১ ম্যাচে গোল, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টানা চার মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইউরোপের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চসংখ্যক চারটি হ্যাটট্রিকের মালিক, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টানা চারবার বর্ষসেরা -এমন অসংখ্য রেকর্ডে নিজের নাম লিখিয়েছেন বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

বুধবার রাতে অনন্য একটি মাইলফলকও ছুঁয়েছেন মেসি। স্পেনের বাইরের প্রথম কোনো খেলোয়াড় হিসেবে বার্সেলোনার জার্সিতে ৫০০ ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেছেন আর্জেন্টাইন তারকা। মেসি নিজের মাইলফলক ছোঁয়া ম্যাচে একটি গোলও করেছেন। বার্সায় ১১ বছরের ক্যারিয়ারে ৫০০ ম্যাচে মেসির মোট গোল ৪২৫টি। আর ট্রফি জিতেছেন ২৬টি। এত সব কীর্তি থেকে মেসির স্মরণীয় ১০টি মুহূর্ত আলাদা করে ‘রাইজিংবিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

এক.২০০৫ সালের ১ মে। লা লিগায় আলবাকেতের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। দিনটা মেসির জন্য সব সময়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বার্সেলোনার জার্সিতে নিজের প্রথম গোলটা যে ওই দিনটাতেই করেছিলেন মেসি, যা বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় গোল করার রেকর্ডও (১৭ বছর ১০ মাস ৭ দিন)। পরে অবশ্য রেকর্ডরা ভেঙে দেন বোয়ান কিরকিচ। বোয়ানকে সে গোলে সহায়তা করেছিলেন কে জানেন? মেসি! আর মেসির প্রথম গোলে সহায়তা করেছিলেন রোনালদিনহো। ব্রাজিলিয়ান তারকার পাস থেকেই বার্সার জার্সিতে নিজের প্রথম গোলটা করেছিলেন মেসি। আলবাকেতের দুই খেলোয়াড়ের মাথার ওপর দিয়ে দারুণ এক পাস দিয়েছিলেন রোনালদিনহো। বল পেয়ে বাঁ পায়ের শটে প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন মেসি।

দুই.সদ্যই তিন মাসের ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন। তাও আবার ‘এল ক্লাসিকো’ মহারণের ম্যাচে। ২০০৭ সালের মার্চে ন্যু ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা মেসির দারুণ এক হ্যাটট্রিকে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ৩-৩ গোলে ড্র করেছিল এক সময় দশ জনের দলে পরিণত হওয়া বার্সেলোনা। সেদিন তিন-তিনবার এগিয়ে গিয়েছিল রিয়াল। পঞ্চম মিনিটে রুড ফন নিস্টেলরয় রিয়ালকে এগিয়ে দেওয়ার ছয় মিনিট পরেই বার্সাকে সমতায় ফেরান মেসি। দুই মিনিট পর ওই নিস্টেলরয় রিয়ালকে আবার এগিয়ে (২-১) দেন। ২৭ মিনিটে মেসির দ্বিতীয় গোলে স্কোরলাইন হয় ২-২। এরপর ৭৩ মিনিটে সার্জিও রামোস গোল করে রিয়ালকে ৩-২ গোলে এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল বার্সা। তবে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার মাত্র তিন মিনিট আগে দারুণ এক গোলে বার্সার এক পয়েন্ট নিশ্চিত করেন মেসি। রিয়ালের দুই খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে ফাঁকি দিয়ে হ্যাটট্রিক পূরণ করা গোলটি করেছিলেন বার্সা ফরোয়ার্ড।

তিন.২০১১ সালের ডিসেম্বর। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসের মুখোমুখি হয়েছিল বার্সা। জাপানের ইয়োকোহামার নিশান স্টেডিয়ামে সান্তোসকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা। দলের হয়ে সেদিন জোড়া গোল করে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন মেসি। জিতেছিলেন টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কারও। চার বছর আগের ওই ম্যাচে মেসির প্রতিপক্ষ দলে ছিলেন কে জানেন? এখন যার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই ক্লাবে খেলেন সেই নেইমার।

চার.২০১১ সালের মে। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও বার্সেলোনা। মাঠে নামার আগে এগিয়ে ছিল ইউনাইটেডই। কারণ ওই ম্যাচে যে ছিলেন না বার্সার আক্রমণভাগের দুই তারকা স্যামুয়েল ইতো আর থিয়েরি অঁরি। তারপরও পেদ্রো, মেসি ও ডেভিড ভিয়ার একটি করে গোলে ৩-১ গোলের জয়ে শিরোপা জিতেছিল বার্সা। আর মেসির করা দলের দ্বিতীয় গোলটি ছিল দর্শনীয়। ২৫ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত এক শটে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন মেসি। পুরো ম্যাচে দারুণ পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাচ-সেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন আর্জেন্টিনা ফরোয়ার্ড।

পাঁচ.২০১৪ সালের মার্চে ‘এল ক্লাসিকো’তে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলতে গিয়েছিল বার্সেলোনা। মেসির হ্যাটট্রিকে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৪-৩ গোলের রুদ্ধশ্বাস জয় পেয়েছিল কাতালানরা। আর এই ম্যাচেই ‘এল ক্লাসিকো’তে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর সর্বোচ্চ গোলের (১৮) রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন মেসি। ওইদিন মেসির দুটি গোল ছিল পেনাল্টি থেকে, আর দুটিই ছিল দুর্দান্ত।

ছয়.২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ফিফা ক্লাবের বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার ক্লাব স্টুডিয়ানেটসের মুখোমুখি হয়েছিল বার্সেলোনা। আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত সে ম্যাচের ৩৭ মিনিটেই ১-০ পিছিয়ে পড়েছিল বার্সা। তবে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার মাত্র এক মিনিট আগে পেদ্রোর গোলে সমতা ফেরায় তারা। এরপর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। আর অতিরিক্ত সময়ে হেডে দারুণ এক গোল করে বার্সাকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন মেসি।

সাত.মেসির ক্লাব ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ নির্ধারণ করাটা বেশ কঠিনই বটে। ২০১০ সালের এপ্রিলে চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচটাও তালিকার প্রথমে থাকার মতোই। ন্যু ক্যাম্পে ফিরতি লেগেই ওই ম্যাচে মেসি একাই চার গোল করেছিলেন। প্রথমার্ধেই হ্যাটট্রিক পূরণের পর দ্বিতীয়ার্ধে চার নম্বর গোলটি করেছিলেন বার্সা ফরোয়ার্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ের লেভারকুসের বিপক্ষে একটি ম্যাচে পাঁচ গোলও করেছিলেন মেসি, তবে আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচের পারফরম্যান্সই ছিল সেরা।

আট.অনেকে বলে থাকেন, মেসি হেড করতে পারেন না, হেডে তার দুর্বলতা আছে। তবে ২০০৯ সালের মে’তে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে মেসির গোল দেখে থাকলে, ওইরকম কথা মনে হয় কেউ আর বলবে না! রোমের স্ট্যাডিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সেদিন ম্যাচের ১০ মিনিটে বার্সাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ইতো। আর ৭০ মিনিটে দলের ব্যবধান দ্বিগুণ করেন মেসি। জাভির ক্রস থেকে আসা বলে দারুণ এক হেডে চোখ ধাঁধানো গোলটি করেছিলেন বার্সা ফরোয়ার্ড। ইউনাইটেডকে ২-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বার্সা। ইউনাইটেডের পরাজিত দলে কিন্তু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও ছিলেন।

নয়.

সর্বকালের সেরা গোলগুলোর একটা তালিকা করলে ২০০৭ সালের এপ্রিলে কোপা ডেল রেতে গেটাফের বিপক্ষে ম্যাচে মেসির প্রথম গোলটা নিঃসন্দেহে তালিকার সেরা তিনে থাকবে! সেমিফাইনালের প্রথম লেগের ওই ম্যাচে বার্সা জিতেছিল ৫-২ গোলে। মেসি করেছিলেন জোড়া গোল। কিন্তু তার প্রথম গোলটা ছিল দুর্দান্ত। মাঝ মাঠে বল পেয়েছিলেন মেসি। আর সেখান থেকে একে একে গেটাফের চার খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন মেসি। আর বক্সের ঢুকে গেটাফের গোলরক্ষককেও কাটিয়ে অনন্য-অসাধারণ এক গোল করেন বার্সা ফরোয়ার্ড। ওই গোলটিকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টাইন কিংবদন্দি ম্যারাডোনার গোলটির সঙ্গেও তুলনা করা হয়।

দশ.ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রেবল জিতেছে বার্সেলোনা। গত মৌসুমে প্রথমে লা লিগা জিতে যার শুরু। এরপর কোপা ডেল রে জিতে ডাবল। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ট্রেবল জয়ের কীর্তি গড়ে তারা। কোপা ডেল রের ফাইনালে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে বার্সার ৩-১ ব্যবধানে জয়ে জোড়া গোল করেছিলেন মেসি। তবে মেসির প্রথম গোলটা ছিল দেখার মতো। মধ্যরেখার একটু ওপরে বল পেয়েছিলেন মেসি। সেখান থেকে হঠাৎ করেই দৌড় শুরু করেন। সামনে বিলবাওয়ের রক্ষণের তিন খেলোয়াড়ের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়েন বক্সে। সামনে আরেক ডিফেন্ডার থাকায় একটু গতি কমিয়ে এনে বাঁ পায়ে জোরালো শট করেন মেসি। বিলবাও গোলরক্ষকের সাধ্যই ছিল না সেটা ঠেকানোর।



মন্তব্য চালু নেই