মেট্রোরেল প্রকল্প স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে

শুধু মুম্বাই, জাপান কিংবা কানাডায় নয়, এবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চলবে মেট্রোরেল। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)’র অর্থায়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেট্রোরেলের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার দৈর্ঘের ‘ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (ডিএমআরটিডিপি) বাস্তবায়ন করছে ‘ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ’ (ডিটিসিএ)।

মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য ‘ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে একটি কোম্পানিও গঠন করেছে সরকার। ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন সক্ষম এ রেল ২০১৯ সালে উদ্বোধনের লক্ষ্যে কাজ করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক মোফাজ্জেল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, মোট আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হবে মেট্রোরেল। ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দরপত্র প্রক্রিয়া চলবে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চুক্তি সই হতে পারে। সব ঠিক থাকলে প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে। ২০২৪ সালে শেষ হবে সম্পূর্ণ কাজ।জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে কার্যকরী ও দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা, সর্বসাধারণের জন্য গণপরিবহন সুবিধাদির ব্যবস্থা করা এবং নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে মেট্রোরেল চালু করার জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সম্ভাব্যতা যাচাই আর নকশা অনুমোদনসহ নানা জটিলতায় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি শুরুই করতে দেরি হয়। তবে সব জটিলতা কাটিয়ে উঠে মূল কাজ শুরু করার জন্য প্রায় প্রস্তুত প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে মেট্রোরেলের লিগাল এ্যাফেয়ার্সের ম্যানেজার খান মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, টেকনিক্যাল কারণে কিছু সময় লেগেছে। কিন্তু মন্ত্রী ও সচিব মহোদয় এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। আর পিডি স্যার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সবাই মিলে কাজ করায় আমরা অনেকটা এগিয়ে গেছি।

এ প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। ঘণ্টায় গতি হবে গড়ে ৩২ কিলোমিটার (সর্বোচ্চ ১শ’ কিলোমিটার)। চলাচলকারী মোট ২৪টি ট্রেনের প্রতিটিতে ৬টি করে বগি থাকবে। প্রতিটি ট্রেনে ৯শ’ ৪২জন যাত্রী বসে ও ৭শ’ ৫৪জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারবে। প্রতি ৪ মিনিট পর পর ট্রেন ছেড়ে যাবে এবং ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করবে।

মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হবে বলে জানা যায়।প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯শ’ ৮৫ দশমিক ৭ কোটি টাকা। জাইকা থেকে পাওয়া যাবে ১৬ হাজার ৫শ’ ৯৪ দশমিক ৫৯ কোটি ও বাংলাদেশ সরকারের ৫ হাজার ৩শ’ ৯০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত দিয়েছে প্রায় ৪শ’ কোটি ও জাইকা দিয়েছে প্রায় ১শ’ ৪৫ কোটি টাকা।

আগামী অর্থ বছরে বড় বরাদ্দ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। মেট্রোরেলে থাকবে ১৬টি স্টেশন। মেট্রোরেলের নির্ধারিত রুট হচ্ছে উত্তরা ৩য় ফেইজ-রোকেয়া সরণীর পশ্চিম পাশ দিয়ে খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড-বাংলাদেশ ব্যাংক (মিতিঝিল)।মেট্রোরেল পুরোটাই হবে উড়ালপথে। বিদ্যমান সড়কের মাঝখানে আড়াই মিটার জায়গা নেয়া হচ্ছে। উচ্চতা হবে মাটি থেকে আট থেকে ১৩ মিটার পর্যন্ত। তিন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে প্রকল্পটি। মোট ২৪ সেট রোলিং স্টক থাকবে এবং প্রত্যেক সেটে ৬টি কার থাকবে।

এছাড়া লিফট, এসি, হুইল চেয়ার, স্বয়ংক্রিয় টিকেটিং সিস্টেমসহ নানা সুযোগ সুবিধা থাকবে এ রেলে।মেট্রোরেলের জন্য ১৬টি স্টেশন প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, উত্তরার উত্তর, উত্তরা কেন্দ্র, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয়সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টেশনগুলো ওপরে হবে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের উপরে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। কনসালটেন (জিসি) হিসেবে ৯শ’ ২ কোটি টাকা চুক্তিতে যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান ও বাংলাদেশের সাত প্রতিষ্ঠানকে (এনকেডিএম এসোসিয়েশন) ৮ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে এর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, ভূতাত্ত্বিক জরিপের ফিল্ড টেস্টে ও সংগ্রহ, রাইট অব ওয়ে, প্রতœতাত্ত্বিক জরিপের কাজ চলছে। সম্পূর্ণ প্রকল্পটি মোট ৮টি প্যাকেজে সম্পন্ন হবে। এর মধ্যে কয়েকটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ইঞ্জিনিয়ার সাইদুর রহমান জানান, উত্তরা থার্ড ফেজ থেকে কাজ শুরু করা হয়েছে। মতিঝিলে গিয়ে শেষ হবে। মোট ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে।

মেট্রোরেল আইন অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হলে ডিটিসিএ একটি কমিটির মাধ্যমে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করবে। রেলের পরিদর্শকও তারা নিয়োগ দেবে। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করলে ভাড়ার ১০ গুণ জরিমানা গুনতে হবে। মেট্রোরেল ও যাত্রীর বীমা বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া লাইসেন্স হস্তান্তর করলে ১০ বছর কারাদ- ও এক কোটি টাকা জরিমানা, পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করলে দুই বছর জেল ও ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই