মেঘনায় লঞ্চডুবি ২৬০ আরোহী গেল কোথায়?
মেঘনায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ এ মোট আরোহী ছিল ৩৬৫ জন। তার মানে ২০২ জন ধারণক্ষমতার লঞ্চটি অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলছিল। এর মধ্যে ৩৩০ জন সাধারণ যাত্রী, কেবিনে ২১ জন আর শুকানিসহ স্টাফ মিলে ছিলেন ১৪ জন।
দুর্ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর শনিবার ভোর ৪টার দিকে লঞ্চটি উদ্ধার করে তীরে আনা হয়। সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার। কিন্তু এর পর সন্ধ্যা পর্যন্ত আরো ৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। সে হিসাবে, এ পর্যন্ত ৫৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে আর ৫০ জনের মতো সাঁতরে তীরে উঠেছে অথবা জীবিত উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু এখনো ২৬০ জন আরোহীর কোনো খোঁজ নেই। প্রশাসনের কাছেও তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।
শনিবার উদ্ধারকৃত লঞ্চটিতে প্রাপ্ত লগবই থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা থেকে যাওয়া একটি পর্যবেক্ষক দল সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই লগবই উদ্ধার করে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ড. এটিএম মাহবুবুল হকের কাছে হস্তান্তর করে।
ইউএনএও লগবইটির প্রাপ্তি স্বীকার করে বলেন, ‘ঢাকা থেকে আসা পর্যবেক্ষকদের একটি দল লঞ্চের লগবই উদ্ধার করে আমার কাছে জমা দিয়েছে। সেখানের হিসাব অনুযায়ী যাত্রীর সংখ্যা ৩৬৫ জন।’
তিনি আরো জানান, প্রশাসন থেকে স্বজনদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। সে হিসাবে ৫৫ জনের লাশ উদ্ধার করে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ীই এখনো নিখোঁজ ৬ জন। তবে যারা সাঁতরে তীরে উঠেছেন তাদের হিসাব রাখা হয়নি। আর জীবিত উদ্ধারের কোনো তালিকাও নেই।
নিখোঁজের কোনো তথ্য পেলে সাংবাদিকদের জানাতে বলেন। এবং জানান যে, তাদের উদ্ধার অভিযান এখনো অব্যাহত আছে।
এদিকে লাশের সন্ধানে মেঘনাতীরে এখনো চলছে স্বজনদের বুকফাটা আহজারি। এ অবস্থায় উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করায় বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। তবে স্থানীয় সাংসদ ঘোষণা দিয়েছেন, উদ্ধারকাজ চলবে।
ডুবে যাওয়া এমভি মিরাজ-৪ লঞ্চটি থেকে পাওয়া লগবই থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার ৩৬৫ জন যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়। দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা নদীবন্দরের সদরঘাট টার্মিনাল থেকে শরীয়তপুরের সুরেশ্বরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গজারিয়ার ইমামপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর কালীপুরা এলাকায় পৌঁছালে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময় পেছনে থাকা অন্য একটি লঞ্চ থেকে বয়া ও লাইফ জ্যাকেট নদীতে ফেলা হলে সেগুলোর সহায়তায় ৫০ জনের মতো যাত্রী তীরে উঠতে সক্ষম হন।
শনিবার দুপুরে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ এ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তখন পর্যন্ত উদ্ধারকৃত লাশের সংখ্যা ৫৪টি বলে জানানো হয়। তবে তখন মাত্র ১২ জন নিখোঁজের কথা উল্লেখ করা হয়। এসময় স্থানীয় সাংসদ মৃণাল কান্তি দাশ, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামছুদ্দোহা খন্দকার, জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল হাসান, জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি- তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক জানান, ভোরে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ক্রেনের সাহায্যে ডুবে যওয়া লঞ্চটিকে মেঘনা পাড়ে দৌলতপুর চরে তুলে আনে। এরপর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নিখোঁজদের স্বজনরা।
এ অবস্থায় স্থানীয় সাংসদ মৃণাল কান্তি দাশ ও নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের দাবির মুখে তিন ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে আবার উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়। বিকেল ৩টার দিকে ফের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ। তবে জেলা প্রশাসনের উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান সাংসদ।
এদিকে এ ঘটনায় নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপস সার্ভেয়ার এএফএম সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান।
ঢাকা থেকে যাওয়া যে পর্যবেক্ষক দলটি ওই লগবই উদ্ধার করে সে দলে ছিলেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সগযোগী অধ্যাপক মোশাইদা সুলতানা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী কাঁকন বিশ্বাস ও হিমালয় হিমু।
প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা বলেন, ‘লগবই অনুযায়ী আমরা জানি লঞ্চ ছাড়ার সময় তাতে ৩৬৫ জন যাত্রী ছিল। দুর্ঘটনার পর মৃত উদ্ধার করা হয়েছে ৫৫ জন এবং জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৫০ জন। এই ১০৫ জনের বাইরে যে বাকি ২৬০ জন, তাদের কী হলো? আমরা এই অচিহ্নিত অংশের হিসাব চাই।’
উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়ের বিষয়ে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এই জাহাজ এখানে এসেছিল পরীক্ষামূলক কাজে। তাদের এটা ছিল প্রথম উদ্ধার অভিযান যে কারণে উদ্ধারে দেরি হয়েছে।’ এমভি মিরাজকে যারা নৌপথে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে তিনি তাদের শাস্তিও দাবি করেন।
তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, ‘প্রশাসনকে আগে এই অচিহ্নিত ২৬০ জনের হিসাব দিতে হবে। এই বিশাল অংশের কী হয়েছে আমরা তা জানতে চাই। আর উদ্ধার করতে কেন দুই দিন লাগল সেটাও জানাতে হবে। এখানে কেন এরকম একটি পরীক্ষামূলক উদ্ধারকাজ চালানো হলো?’
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. মো: শামছুদ্দোহা খন্দকারের সঙ্গে টেলিফোনে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মন্তব্য চালু নেই