মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামি সংখ্যা বেড়েই চলেছে
সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নৈতিক অবক্ষয়,সামাজিক পরিবর্তনকে এ জন্য দায়ী করে নারীদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি ও মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ ও মানবধিকারকর্মীরা।
হাইকোর্ট সূত্রে জানা যায়,বাবা-মাকে হত্যার দায়ে আসামি ঐশী রহমানসহ গত পাঁচ বছরে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নিম্ন আদালতে ২১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারীর মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে শুধু চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ নারী আসামির মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির জন্য আসে। এটা এক বছরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মামলা।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘ইতোপূর্বে নারী অপরাধীর সংখ্যা ছিল না বললে চলে। এ কারণে নারী মুক্তির জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু বর্তমানে এ চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুরুষের পাশাপাশি নারী অপরাধীর সংখ্যা সমান তালে বাড়ছে। এর কারণ আকাশ সংস্কৃতি। বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে সিরিয়াল দেখে নারীরা ভালো ধারণার পরিবর্তে পরকীয়া, মাদকাসাক্ত হচ্ছে। ভালো কিছু শেখার পরিবর্তে নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে।’
কেস স্টাডি-১
পরকীয়ার কারণে নবজাতক সন্তানকে হত্যার কারণে গত ২১ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা আদালতে মা রিজিয়া খাতুনকে (২৫) মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতের বিচারক শরীফ এএম রেজা জাকের এ আদেশ দেন। সাজাপ্রাপ্ত রিজিয়া খাতুন কালিগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর গ্রামের আব্দুল মাজেদ গাজীর মেয়ে।
মামলার বিবরণে জানা যায়,২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের রহিমপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তারের পুকুর পাড় থেকে এক নবজাকতের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এলাকাবাসী অভিযোগ করে, ওই গ্রামের রিজিয়া খাতুন ও একই উপজেলার পাশের গ্রাম পাইকাড়ার কাশেম কাপালীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ওই নবজাতকের জন্ম হয়। ময়নাতদন্তে ওই নবজাতককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা হলেও পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হলে পুলিশ রিজিয়া খাতুন ও কাশেম কাপালীকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় রিজিয়া খাতুন আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান। পরে ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও নথি পর্যালোচনা করে আদালত পলাতক রিজিয়া খাতুনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত। আর অপর আসামি কাশেম কাপালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়। এ মামলাটি হাইকোর্টে ডেথরেফারেন্স শুনানির জন্য আসে।
কেস স্টাডি-২
পরকীয়ার কারণে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে স্বামী মোশাররফকে হত্যার দায়ে স্ত্রী তাসলিমা বেগমসহ দুজনকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। ঢাকার প্রথম অতিরিক্তি মহানগর দায়রা জজ জেসমিন আরা বেগম এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন,নিহতের স্ত্রী তাসলিমা বেগম এবং তার কথিত প্রেমিক রাসেল। রায়ে প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। রায় ঘোষণার সময় দুই আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদ এলাকায় ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর তাসলিমা বেগম তার স্বামী মোশাররফকে হত্যার উদ্দেশ্যে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। খাবার খেয়ে মোশাররফ ঘুমিয়ে পড়লে তাসলিমা বেগম ও প্রেমিক রাসেল তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। এতে সঙ্গে সঙ্গে মোশাররফের মৃত্যু হয়। পরে দুই জনে মিলে ঘরের মেঝেতে খাটের নিচে লাশ পুঁতে রাখে। স্বামীকে হত্যা করার পর কয়েকদিন ধরে তাসলিমার আচরণ অস্বাভাবিক মনে হলে মোশাররফের পরিবারের লোকজন থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় নিহতের বড় ভাই আব্দুল জলিল বাদী হয়ে কামরাঙ্গীরচর থানায় ওই বছর ১৩ অক্টোবর একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডেথ রেফারন্স শাখার হিসেব মতে,২০১২ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে আাদলতে ২১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামির মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষমাণ রয়েছে। তারা হলেন-সাতক্ষীরা আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রিজিয়া খাতুন,গত ২১ জানুয়ারি ২০১৬ সাতক্ষীরা আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। একইভাবে ঢাকার আদালতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাসলিমা বেগম,যশোরে ১৪ মার্চ সাবানা খাতুন,খুলনায় আদালতে ২৮ মার্চ ফাতেমা আক্তার সোনালী,১১ মে যশোরের আদালতে বিলকিস বেগম,নরসিংদী আদালতে ২০ মে জাহানারা আক্তার,গাজীপুর-১০ মে,রোজিনা আক্তার,২৫ মে কুমিল্লা আদালতে শিউলি আক্তার, সিলেটের আদালতে ৬ জুন ফাতেমা মাসকুরা,কুমিল্লা আদালতে ৭ জুন শাহীনা আক্তার,রংপুরে ৩০ মে আদুরি রানী মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। এ ছাড়া ২০১৫ সালে যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন পাঁচজন হলেন-রংপুরের আদালতে ২০১৫ সালের ৭ মে সাজেদা বেগম, যশোরের আদালতে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট বিনারানী তরফদার,রংপুরের আদালতে ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট সুফিয়া বেগম,ঢাকা জজ কোর্টে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ঐশী রহমান, চট্টগ্রামের আদালতে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর রহিমা বেগম। ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সংখ্যা হলো-মুন্সিগঞ্জের আদালতে লুৎফা বেগম,২০১৩ সালে ঢাকা আদালতে-২ জন খাদিজা বেগম,কুমিল্লা আদালতে উম্মে হানি ওরফে উর্মি, ২০১২ সালে-একজন ঢাকা জজ কোর্টে শিল্পী ওরফে হাওয়া।
এ ছাড়া আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার দেওয়া তথ্য মতে, এ পর্যন্ত হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল ছিলো এ রকম প্রায় ২৫ নারীর আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ আসামি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন বা খালাস পেয়েছেন। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক চাঞ্চল্যকর শাজনীন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ওই রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই বোন এস্তেমা খাতুন মিনু ও পারভীনকে খালাস পায়।
এ বিষয়ে আপিল বিভাগের আপিল শাখার কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার পর আপিল বিভাগে মামলা আসে। লোকবল সংকটের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পৃথক করে তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে গত সাত বছরে প্রায় ২০ নারীর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যারা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে খালাস পেয়েছেন বা সাজা কমিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখার তথ্য মতে,গত ৩১ মে পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স শাখায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির (নারী পুরুষ মিলে) ৪৫৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তন্মধ্যেএর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ২১জন।
আদালতের নিয়মানুযায়ী, নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড কার্যকর করতে হলে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ সব মামলা এখনো পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামিরা দিনের পর দিন কারাগারের নির্জন সেলে পড়ে রয়েছেন। উচ্চ আদালতে তাদের মামলা নিষ্পত্তি হলে ফাঁসি থেকে মুক্ত অথবা রায় কার্যকর হয়ে যাবে বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান বলেন,’ফৌজদারি মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে পাচ্ছি,বেশির ভাগ হত্যা মামলার আসামির মৃত্যুদণ্ডের পেছনের কারণ হিসেবে পরকিয়া, মাদকাসক্তি, যৌতুক প্রথা এবং সামাজিক অবক্ষয়,নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিগত বছরগুলোতে নারীরা জড়িত না থকলেও এখন ক্রমে বাড়ছে। যা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ।’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ বলেন,’আমাদের সমাজের বড় ধরনের অবক্ষয় হয়েছে,এটা কোনো মত গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবারকে অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতা করা উচিৎ। পাশাপাশি আমি বলবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ সব মামলা নিষ্পত্তি করা উচিৎ।’-এনটিভি
মন্তব্য চালু নেই