মুসা-তৃষার নিখোঁজের তথ্য দেয়নি পরিবার

রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশি অভিযানে চার মাসের শিশু সন্তানসহ গ্রেফতার হয়েছেন নব্য জেএমবির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মইনুল ইসলাম ওরফে মুসার স্ত্রী তৃষা মনি। তিনি ও তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরেই নিখোঁজ ছিলেন।

সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে এ দম্পতি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গণিপুরের বুজরুককোলায় এসেছিলেন। বিদেশ যাওয়ার কথা বলে ওইসময় গ্রাম ছেড়ে যান তারা। এরপর থেকেই নিরুদ্দেশ ছিলেন মুসা ও তৃষা।

সম্প্রতি দেশজুড়ে জঙ্গিবাদ ইস্যু আলোচনায় এলে নিখোঁজদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ওই দুজনের নিখোঁজের তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়নি পরিবার।

এ বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুঁইয়া বলেন, মুসা নামে মইনুলকে তার গ্রামের লোকজন চেনেন না। এটা হতে পারে তার টেক নাম। তবে আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পরপরই নাম দুটি জেলা পুলিশের কাছে আসে। পুলিশ তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। তবে তারা যেহেতু বেশ কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি সেহেতু বিষয়টি অনেকেই জানেন না। এটা ঠিক মুসা বা তৃষার পরিবারের কেউ আগে পুলিশকে তাদের নিখোঁজের তথ্য দেয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

এদিকে, তৃষা মনি ও তার স্বামী মইনুল ইসলাম ওরফে মুসার জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় মর্মাহত দুই পরিবারই। সামাজিকভাবেও এখন কোনঠাসা পরিবার দুটি। মেধাবী ছাত্র মইনুলের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার খবরে হতবাক এলাকার মানুষও। গ্রামের লোকজন মইনুলকে মুসা নামে চেনেন না। সেই মইনুল যে নব্য জেএমবির নেতা মুসা সেটা তারা জেনেছেন মিডিয়ার কল্যাণে।

অন্যদিকে মইনুলের স্ত্রী তৃষার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মইনুলের পরিবার ইসলামী ভাবধারার রক্ষণশীল পরিবার। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কাছাকাছি দুই এলাকার বাসিন্দা মুসা-তৃষার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তৃষার জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া ও গ্রেফতারের খবরটিও এলাকাবাসী জেনেছে ওই দিনই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মইনুল ওরফে মুসা বুজরুককোলা গ্রামের আবুল কামাল মোল্লার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় ছেলে। কামাল মোল্লা গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। মুসার মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। কালাম মোল্লার দ্বিতীয় স্ত্রীর আরও তিন সন্তান রয়েছে। মুসাদের বাড়িতে এখন লোকজনের আনাগোনা সারাদিনই থাকছে। মইনুলের মা সুফিয়া বেগম অপরিচিত বা আগন্তুক দেখেই আঁতকে উঠছেন। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিলেও মাঝে মাঝেই হাউমাউ করে কাঁদছেন।

সুফিয়া বেগম জানান, পড়ালেখায় ছেলেটার মাথা ভালো ছিল। তার ওপর পরিবারের আশাও ছিল অনেক। কিন্তু সে এভাবে পথ হারাবে এটা ভাবতেই পারেনি কেউ।

গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগমারার মচমইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মইনুল মাধ্যমিক ও তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকে ঢাকায় চলে যান। ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করে চাকরি নিয়েছিলেন শিক্ষকতার।

২০১৫ সালের মাঝামাঝি চাকরি পেয়ে বাড়িতে এসে বিয়ে করেন পার্শ্ববর্তী বাসুপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদের মেয়ে তৃষা মনিকে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে বাড়িতে এসেছিলেন মুসা। এরপর জানিয়েছিল বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই সময় বাবার কিছু জমিও বিক্রি করে টাকা নিয়ে যান। এরপর সে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি পরিবারের সঙ্গে।

মুসার ভাই খাইরুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ যখন বউ নিয়ে বাড়িতে আসে, তখন মইনুলের আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখেন তারা। ব্যাগভর্তি বইও সঙ্গে ছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলেনি। বাড়ির বাইরে কম যেতো। একদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই সব কিছু গুছিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে আর ফোনও করেনি। আমরা ভাবতাম বিদেশে চলে গেছে।

গনিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান জানান, ছেলেটা তো খুব মেধাবী ছিল। লেখাপড়ায় খুব ভালো হওয়ায় অনেকেই বলতেন ম্যাজিস্ট্রেট হবে। তার পরিবারও তার ওপর ভরসা করতো। মইনুলের খবরটা জেনে খুব খারাপই লেগেছে। বিপথগামী হয়ে ছেলেটা এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে, আবার পরিবারকেও হেয় করবে আমরা তা কখনও ভাবিনি।

অন্যদিকে তৃষা মনি বাসুপাড়া ইউনিয়নের সাঁইপাড়ার আবদুস সামাদের বড় মেয়ে। আবদুস সামাদ বাসুপাড়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সামাদের যমজ দুই মেয়ে তৃষা আর নিশার মধ্যে তৃষা বড়। সাঁইপাড়া হাইস্কুল থেকে ২০১৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন সৈয়দপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে। কলেজে ভর্তির পরপরই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মইনুলের সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিন পরই বোরখা পরা শুরু করেন তৃষা। নামাজও পড়তে শুরু করেন নিয়মিত। কলেজে কিছুদিন গেলেও পরে আর যান নি।

কয়েক মাস পর স্বামী মইনুলের সঙ্গে ঢাকায় চলে যান। বিয়ের পর দু’বার শ্বশুর বাড়িতে এসেছে মইনুল। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে আসেন গ্রামে। ওই সময় তাদের সব ছবি পুড়িয়ে দিয়ে যান। ৯ মাস তৃষা পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি।

তৃষার মা নাজমা বিবি জানান, ঢাকা থেকে পুলিশ ফোন করেছিল রোববার রাতে। তাদের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যেতে বলেন। এজন্য তারা পরিবারের সবাই সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছান। মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।

তবে নাজমা বিবি বলেন, আমাদের কপাল খারাপ। আমরা টেরও পাইনি ওরা এ পথে যাবে। আমরা এখন শুধু আল্লাহকে ডাকছি।



মন্তব্য চালু নেই