মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনের জীবন চলছে মরিচিকার আশায়
মোঃ শামীম আখতার, উপজেলা প্রতিনিধি, মিঠাপুকুর (রংপুর): মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন সরকার (৭০)। নৈশ্য প্রহরীর কাজ করেন একটি বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানে। বছরখানেক ধরে বেতন পাননা তিনি। আগামী ক’মাসের মধ্যে তিনি বেতন পাবেন তাও জানা নেই। তাঁর বড় ছেলে সুশান্তের চৌকিদারের চাকুরি হয়নি উৎকোচের টাকা না দেওয়ার করণে। চেয়ারম্যানের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারে গৃহ নির্মান প্রকল্পে আবেদন করেছিলেন মনোরঞ্জন সরকার। কিন্তু, তিনি তা পাননি। আগামীতে বরাদ্দ আসলে পাবেন-এমন মরিচিকার মত আশা তাঁর। এখন ৭ সদস্যের পরিবার চলছে মনরঞ্জনের কর্মকারের রোজগার দিয়ে।
উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে মিঠাপুকুর-ফুলবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের ধারে পল্লী গ্রাম জালাদীপুর। এই গ্রামে থাকেন তিনি। তাঁকে খোঁজার যাত্রা শুরু হলো। মোটর সাইকেলে যেতে সময় লাগলো মিনিট দশেক। মহাসড়ক থেকে উত্তরদিকে ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে আঁকা-বাঁকা হাঁটা পথে ৫ মিনিটের মত সময় লাগলো মনোরঞ্জনের বাড়িতে পৌঁছাতে।
বাড়িতে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরমুখী ৩টি কুঁড়েঘর। ছোট্ট একটি উঠান। মনোরঞ্জনের খোঁজ করতেই বেরিয়ে আসলেন ৫০ উর্ধ্ব এক বৃদ্ধা। হাসিমুখে বললেন তিনি বাড়ী নেই, দোকানে আছেন। বুঝতে বাকি রইল না-এই বৃদ্ধাই মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনের স্ত্রী। নাম দিপালী রানী।
তাঁর সাথে দু’একটা কথা বলতেই বাড়ি থেকে একটি শিশু কোলে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন এক যুবক। বললেন, বাবু বাড়িতে নেই। হাটে আছেন, দোকানে। আমরা ওই যুবককে সাথে নিয়ে পা বাড়ালাম। আসতে আসতে যুবকটি জানালেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনের বড় ছেলে সুশান্ত। সুশান্ত স্থানীয় বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা অবস্থায় বিয়ে করেন।
এখন কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে স্ত্রী ও ১ সন্তানকে নিয়ে সংসার করছেন। প্রশান্ত নামে আরো একজন ভাই রয়েছে সুশান্তের। প্রশান্ত ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর বিদ্যালয়ে যাননি। বিয়ে করেছেন অনেক আগেই। তাঁর ১ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান।
চেংমারী ইউনিয়নের জালাদিপুর গ্রামের কাছে ছোট্ট একটি বাজার, নাম পাগলারহাট। বেলা পৌনে এগারোটার দিকে বাজারে দেখা হলো মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনের সাথে। মুখের গালগুলো বসে গেছে বয়সের ভারে। গায়ের চামড়াগুলো কুচকানো। দোকানে বসে তিনি আগুনে লোহা গলানোর কাজ করছেন। খোলা জায়গায় একটি পিঁড়িতে বসে কাজে ব্যস্ত তিনি। মাথার উপরে চট দিয়ে ছাউনি দিয়েছেন। সাংবাদিকদের দেখে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন।
জানালেন- প্রচন্ড কাজের চাপ। কৃষি সরঞ্জামের ব্যাপক চাহিদা বর্তমানে। তাই, দম ফেলবার ফুসরত নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করেন কর্মকারের। যে জায়গাটিতে তিনি দোকান পেতেছেন সেটি ৬ বর্গফুটের বেশি হবে না। জায়গাটি মনোরঞ্জনের নিজের নয়। ভাড়া নিয়েছেন স্থানীয় লুৎফর রহমানের কাছে। বিনিময়ে দিতে হয় প্রতিদিনি ১৫ টাকা করে। এই কর্মকারের দোকানে কাজ করে তিনি প্রতিদিন রোজগার করেন প্রায় দেড়’শ টাকা।
বেলা ১১ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন সরঞ্জারম গোছাতে শুরু করলেন। বললেন সকাল থেকে কিছুই খাননি। ক্ষিধে পেয়েছে, বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবেন। আমরাও এগুতে থাকি মনোরঞ্জনের সাথে। বাড়ির উত্তর কোনে একটি জলচৌকিতে খেতে বসেছেন তিনি। ডাল ভাত খাচ্ছেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। স্ত্রী, ২ ছেলে ও নাতি-নাতনীসহ খাচ্ছেন পরিবারের ৭ সদস্য।
তিনি জানালেন- আমার একার রোজগারে সকলের মুখে অন্ন জোটে। দু’ ছেলে অন্যের কৃষি জমিতে কাজ করেন। বছরের বেশিরভাগ সময়ই কাজ থাকেনা। তখন সংসারের খরচ চলে মনোরঞ্জনের টাকায়।
২০১০ সালে মনোরঞ্জন নৈশপ্রহরীর চাকুরি নেন মিঠাপুকুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। বছর খানেক ধরে বিল বেতন দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন বলেন, গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে বেতন পাচ্ছি না। কর্তৃপক্ষকে বললে দিবে দিচ্ছি করছে।
বছরখানের আগে বড় ছেলে সুশান্তের চাকুরির হওয়ার কথা ছিল চেংমারী ইউনিয়নের চৌকিদার হিসেবে। কিন্তু, সেটি ভাগ্যে জোটেনি তাঁর। স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মন্ডল চৌকিদারের চাকুরি দেওয়ার জন্য দাবি করেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। মিঠাপুকুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী শেখকে সাথে নিয়ে বেশ কয়েকবার দেখা করেছেন চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মন্ডলের সাথে। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন প্রভাবশালীদের কাছে। তারপরেও চৌকিদারের চাকুরি হয়নি মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনের ছেলে সুশান্তের।
মিঠাপুকুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী শেখ বলেন, আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু, তারপরও সুশান্তের চৌকিদারির চাকুরিটা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন বলেন, আমি চেয়ারম্যানের কাছে ঘুরতে ঘুরতে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করেছি, তিনি আমার কথা শোনেননি। বেশ কয়েকদিন তিনি আমার সাথে খারাপ আচরণও করেছেন। চেংমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মন্ডল বলেন, হাসান মেম্বার নামে ইউপি সদস্য অন্য একজনকে চৌকিদারের চাকুরী নেওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিল। আমরা সবাই মিলে টাকাগুলো ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমি মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনকে বলেছিলাম ওই টাকা দিলে তার ছেলের চাকুরি হবে। পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।
প্রায় ২ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় মিঠাপুকুরে মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জনসহ ১০জন আবেদন করেন। কিন্তু, তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। এ উপজেলা থেকে জিতেন্দ্রনাথ ও মকবুল হোসেন নামে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের পরবর্তীতে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে বলে আশস্ত করা হয়।
মিঠাপুকুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সহিদার রহমান বলেন, মনোরঞ্জন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা। গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে তিনি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু, গোটা উপজেলায় ২ জনের নাম পাশ হয়। বাকিদের পরবর্তীতে দেওয়া কথা। কিন্তু, প্রকল্পটি প্রথম পর্যায়ের কাজ বন্ধ হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহি অফিসার মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন সরকার মিঠাপুকুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে ১৪ মাসের বেতন পাবেন। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকে ডেকে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য বলেছি। তিনি আরও বলেন, মনোরঞ্জন সরকারের ছেলের চৌকিদারি চাকুরী দেওয়ার নামে চেয়ারম্যান উৎকোচ চাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।
মন্তব্য চালু নেই